ছবি : সংগৃহীত
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জরুরি শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) অধীনে শিক্ষকেরা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের বিভিন্ন স্কুলে কয়েক বছর ধরে পাঠদান করে আসছিলেন। সম্প্রতি তহবিল–সংকটের কারণ দেখিয়ে ১ হাজার ২৫০ জন স্থানীয় শিক্ষককে চাকরিচ্যুতের প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। চাকরির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দেন শিক্ষকরা। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এই আড়াই লাখ শিক্ষার্থীর কি হবে?
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থী মৌলিক অধিকারের বাইরে থাকলে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দ্রুত তহবিল সংগ্রহ করে এসব শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনা দরকার।
ইউনিসেফ জানিয়েছে, তহবিল না পাওয়া পর্যন্ত শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধই থাকছে। এই কার্যক্রম বন্ধের প্রভাব পড়েছে শরণার্থী শিবিরগুলোতে শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হওয়া স্কুলগামী শিশুদের ৮৩ শতাংশের ওপর। তহবিল সংগ্রহে এগিয়ে আসার জন্য আন্তর্জাতিক কমিউনিটির প্রতি আহ্বান জানায় সংস্থাটি।
সোমবার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, বাংলাদেশি শিক্ষকরা দাবি আদায়ের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। তারা বলছে চাকরি ফেরত দিতে হবে। অন্যথায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এখানে রোহিঙ্গা শিক্ষক ও বাংলাদেশি শিক্ষক মিলে ৮ হাজারের মতো শিক্ষক রয়েছেন।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) অফিস সূত্রে জানা গেছে, অর্থসংকটের কারণে ইউনিসেফের শিক্ষা প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার অংশ হিসেবে শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। এটা অমানবিক হলেও ইউনিসেফের হাতে টাকা নেই। স্থানীয় শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতির বিষয়টি নিয়ে সরকারের উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। আশ্রয়শিবিরে ৪ হাজারের বেশি শিক্ষক আছেন। শিক্ষকদের যদি আপাতত এক বছর চাকরিতে রাখা হয়, তাহলে ৬০-৮০ কোটি টাকা প্রয়োজন। এই টাকা কীভাবে সংগ্রহ করা যায়, তার চেষ্টা চলছে।
উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার (৩ জুন) সকাল থেকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইউনিসেফের তহবিলে পরিচালিত শিক্ষা প্রকল্পের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে চাকরিচ্যুত শিক্ষকরা কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে অবরোধ শুরু করেন।
এর ফলে এই সড়কে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সড়কে চলাচলকারী যানবাহন ও যাত্রীদের। পরে দুপুরে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিলে সড়ক অবরোধ আন্দোলন স্থগিত করে শিক্ষকরা।
জানা গেছে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে ৭৮টির বেশি এনজিও কাজ করে। এসব সংস্থার অন্তত ২০ হাজার কর্মকর্তা সকাল ৭টা থেকে কক্সবাজার শহর থেকে এসে আশ্রয়শিবিরের কাজ সামলান। বিকেল ৪টার দিকে তারা পুনরায় গাড়ি নিয়ে আশ্রয়শিবির থেকে কক্সবাজার শহরে ফিরে যান। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, অভিবাসন সংস্থা আইওএম, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার শতাধিক কর্মকর্তাও শহর থেকে শিবিরে আসা–যাওয়া করেন। কিন্তু সড়ক অবরোধের কারণে ৩ জুন বেলা একটা পর্যন্ত কেউ আশ্রয়শিবিরে ঢুকতে পারেনি। আশ্রয়শিবিরগুলোতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৪ লাখের বেশি।
আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবি, আশ্রয়শিবিরগুলোতে শিক্ষা প্রকল্পের আওতায় তহবিল-সংকট দেখিয়ে বিনা নোটিশে স্থানীয় (বাংলাদেশি) শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু রোহিঙ্গা ও বহিরাগত (জেলার বাইরের) শিক্ষকদের চাকরিতে বহাল রাখা হয়। এটা বৈষম্য। শিগগির চাকরিতে পুনর্বহাল করা না হলে আশ্রয়শিবিরে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (আইএনজিও) কোনো গাড়ি ঢুকতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু তা কেউ আমলে নেয়নি বলে এই সড়ক অবরোধ কর্মসূচি।
শিক্ষকদের একজন বলেন, ‘গত বছরের সেপ্টেম্বরে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ চার দফা দাবি নিয়ে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। এ কারণে স্থানীয় ১ হাজার ২৫০ শিক্ষককে ছাঁটাই করা হয়েছে। এখন তহবিল–সংকটের কথা বলে দায় এড়ানোর চক্রান্ত চলছে। তহবিল-সংকটের কারণে স্থানীয় লোকজনের চাকরি না থাকলে আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা প্রকল্পও বন্ধ করতে হবে। এই ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আমরা মাঠ ছাড়বো না।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে স্থানীয় শিক্ষকদের নিয়ে ক্যাম্পে স্কুলগুলো পরিচালিত হয়। পরে স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে রোহিঙ্গা শিক্ষক দিয়ে কম বেতনে পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।