নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে. . . | মতামত নিউজ

নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে. . .

বর্ষাকে কেন্দ্র করে লেখা কবি-সাহিত্যিকদের গল্প, গান, কবিতা, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বর্ষায় প্রেম-বিরহ, ভাবাবেগ ফুলে ফেঁপে ওঠে।

‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে,

তিল ঠাঁই আর নাহি রে।

ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’

বিশ্বকবির সৃষ্টির মায়াজালে ফুটে উঠেছে বর্ষার রূপ। বর্ষণমুখর দিনে রিমঝিম শব্দ শুনতে কার না ভালো লাগে! কোথাও পুকুরপাড়ে রিনিঝিনি শব্দ, পত্রপল্লবের ওপর টাপুর-টুপুর, টিনের চালে ঝম-ঝম শব্দে মন যেনো বিহ্বল হয়ে পড়ে। ষড়ঋতুর মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ঋতু হলো বর্ষা। বাংলা সাহিত্যে বর্ষার প্রভাব ব্যাপক। বর্ষা যে কতো সৃজনশীলতা, আবেগ ও সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় তার ইয়ত্তা নেই। লেখকের সৃষ্টি যেনো ভিন্নমাত্রা পায় বর্ষাকে ঘিরে।

বর্ষাকে কেন্দ্র করে লেখা কবি-সাহিত্যিকদের গল্প, গান, কবিতা, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বর্ষায় প্রেম-বিরহ, ভাবাবেগ ফুলে ফেঁপে ওঠে। আষাঢ় মানেই যেনো বর্ষণমুখর দিন। আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল হলেও এর পরিধি আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে জনজীবন যখন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে তখন বর্ষার প্রার্থনা যেনো অবধারিত হয়ে ওঠে।

বর্ষা প্রকৃতিকে সতেজ, স্নিগ্ধ, কোমল আর উজ্জ্বল করে তোলে। মরা নদীও বর্ষায় জেগে ওঠে তার রূপ-যৌবন জানান দিতে চায়। নদ-নদী তার যৌবন ফিরে পায় বর্ষায়। নদীর ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধ, কালো জল যেনো হারিয়ে যায় বর্ষার নাচনে। প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি।

প্রকৃতির রানি বর্ষা। শিল্পরসিক মন বর্ষার বিচিত্রতায় অভিভূত হয়ে যায়। এককথায়, প্রকৃতিকে মন ভরে উপভোগ করতে অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় বর্ষা। শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ বর্ষাকে যেনো একটু বেশি করে উপভোগ করে। বাংলাদেশ যে নদীমাতৃক দেশ এটা পূর্ণতা পায় বর্ষাকালে। বর্ষায় গ্রামগঞ্জের মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওর ও জলাশয় ভরে ওঠে। ছেলেপুলেরা খেলাধুলায় মেতে ওঠে। গ্রামের পথঘাট কাদাজলে মাখামাখি হয়ে যায়।

কোথাও আবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে মানুষ। বৃষ্টিবিলাসে নববধূ, প্রেমিক-প্রেমিকার মন উদাস হয়ে ওঠে। শহুরে জীবনে বর্ষণমুখর দিনে জীবনযাত্রা কিছুটা হলেও গ্রামের চেয়ে ভিন্ন। শহুরে জীবনে বর্ষা মশার উৎপাত বাড়িয়ে দেয়। ব্যস্ত জীবনের ছুটে চলা হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে বর্ষা ভিন্নমাত্রা যোগ করে। ভারী বর্ষণে নগরজীবনে জলাবদ্ধতা আর যানজটের সেই চিরচেনা দৃশ্য দেখা যায়। অনেকে বাড়ির ছাদে উঠে বর্ষাকে উপভোগ করে। অনেক সময় ছেলেপুলেরা বৃষ্টিবিলাসে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। জানালার পাশে কোনো প্রেয়সী উদাস মনে ভাবে তার প্রিয় মানুষের কথা।

অন্যভাবে চিন্তা করলে বর্ষণমুখর দিনে দিনমজুরের ললাটে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কাজ কমে যায়। বর্ষায় গ্রামেগঞ্জের খাল-বিলে শাপলা ফুল ফুটে। কৃষক সেচ কাজের জন্য বর্ষার অপেক্ষায় থাকেন। ভরা যৌবন পাওয়া নদীতে নৌকাবাইচের আয়োজন করা হয়। বর্ষায় প্রেমিকের হাতে ওঠে কদমগুচ্ছ। প্রেয়সীর খোঁপায় স্থান পায় কদমফুল। ভাবুকের মন আরো বেশি উদার ও প্রেম-ভালোবাসায় ভরে ওঠে। এ সময় প্রকৃতিতে ফুটে ওঠে হরেক রকমের ফুল।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।’ কদম, কেয়া, শাপলা, পদ্ম, দোলনচাঁপা, ঘাসফুল, কুমড়া ফুল, ঝিঙেফুল, কচুফুল, কেশরদাম, পাতা শেওলা, পাটফুল, বনতুলসী, নলখাগড়া, হেলেঞ্চাফুল, অর্কিড, কলমি ফুল, ফণীমনসা গোলপাতা ইত্যাদি ফুল প্রকৃতিকে আরো মোহিত করে তোলে। বর্ষাকালের ফলগুলোও পুষ্টিগুণে ও রসে ভরা থাকে। বর্ষাকালে পর্যটন স্থানগুলো আরো বেশি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। বর্ষা পাহাড়ের প্রকৃতিকে যেনো আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তোলে।

বর্ষাকে ভালোবাসার ঋতু বললেও অত্যুক্তি হবে না। বর্ষা ছাড়া প্রকৃতি যেনো পূর্ণতা পায় না। বলা যায় বর্ষা, প্রকৃতি-পরিবেশ ও সৌন্দর্য একই সরলরেখায় বাঁধা। বর্ষার নাচন মানবমনে এক রহস্যময় আবেগ তৈরি করে। বর্ষায় চারপাশ ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যায়। প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় বর্ষা। মাঝে মাঝে আবার প্রকৃতি যেনো তার ব্যাকরণ ভুলে যায়। গ্রীষ্মকালে খরার কবল থেকে বাঁচতে কোথাও বৃষ্টিবন্দনাও দেখা যায়। বাংলাদেশের ওপর দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বর্ষার ব্যাপকতার প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। বর্ষা নাগরিক জীবনে আবার অস্বস্তি নিয়েও হাজির হয়।

ঝড়, বন্যা, পাহাড়ধসসহ বিভিন্ন দুর্যোগে এলোমেলো হয়ে যায় জনজীবন। বর্ষায় বৃক্ষপ্রেম জাগ্রত হয়ে ওঠে। বর্ষাকাল গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের এই সময়ে বৃক্ষসম্পদ সংরক্ষণের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণে উদ্বুদ্ধ করে প্রিয় বর্ষা ঋতু। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও বর্ষার সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণে জাগ্রত হয়। বর্ষার প্রকৃতি অন্যসব ঋতুর চেয়ে আলাদা রূপ ধারণ করে।

প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে আমাদের বেড়ে ওঠার সম্পর্ক রয়েছে সেই জন্মলগ্ন থেকেই। তাই মাটি, গাছপালা, পশু-পাখি, নদী-নালা সর্বোপরি প্রকৃতিকে আমাদের ভালোবাসতে হবে। প্রকৃতিকে ভালোবাসলে প্রকৃতিও আমাদের সঙ্গে সৌন্দর্য ও ভালোবাসার মেলবন্ধন তৈরি করবে। বর্ষা আমাদের জীবনের অশান্তিকে দূরে ঠেলে শান্তির বার্তা নিয়ে আসুক- এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষক