অযোগ্যরা শিক্ষকতা করার চেয়ে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে বেশি বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন।
বৃহস্পতিবার (৮ মে) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে অধ্যাপক মামুন এ কথা বলেন।
অধ্যাপক মামুন বলেন, বাংলাদেশে কি ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার মত যথেষ্ট সংখ্যক মানসম্মত শিক্ষক আছে বা ছিল? আমি বড়জোর ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার মত মোটামুটি মানসম্মত শিক্ষক দেখি।
তাও এই ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধিকাংশই বিশ্বমানের হবে কিনা সন্দেহ। এই অবস্থায় আমরা যত্রতত্র মানহীন এত এত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে ফেলেছি।
ফলে পদ পূরণের জন্য শিক্ষক হওয়ার মত যোগ্যতা যার নাই তাদেরকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানিয়ে ফেলেছি। এই অযোগ্যরা শিক্ষকতা করার চেয়ে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে বেশি।
তিনি বলেন, আমাদের ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষ এইসব শিক্ষকদের টেলিভিশনের টক-শোতে অনর্গল মিথ্যা বলতে দেখেন, রাজনৈতিক নেতাদের পেছনে ঘুরঘুর করতে দেখেন, এমনকি জাতীয় নির্বাচন এলে দলীয় প্রার্থীদের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাদের পক্ষে ভোট ভিক্ষা করতে দেখেছে।
শিক্ষক নামের এই অশিক্ষকদের দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে সমাজে যেই পারসেপশন তৈরি হয়েছে তা মানসম্মত শিক্ষাবিস্তারে মারাত্মক প্রতিবন্ধক। এইটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই প্ৰযোজ্য তা নয়।
শিক্ষার সকল স্তরের শিক্ষকরাই আজ এমন। এই শিক্ষকদের কারণে যৌন হয়রানি, প্রকাশনা চাপের কারণে চৌর্যবৃত্তি, বেতন কম হওয়ার কারণে পার্টটাইম রাজনীতি বা অন্য কিছুতে মন বেশি ব্যস্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মত এত প্রশাসন প্রীতি সম্ভবত পৃথিবীর আর কোথাও নাই। সবাই ভিসি, প্রোভিসি, ইউজিসি ও পিএসসির চেয়ারম্যান, মেম্বার হতে চায়। এতই যদি প্রশাসন ভালো লাগে তাহলে শিক্ষক হয়েছিলেন কেন?
পৃথিবীর অন্যত্র শিক্ষা ও গবেষণায় শিক্ষকরা এক পর্যায়ে যখন বুঝতে পারেন এই দিকে ভালো করবেন না তখন ট্র্যাক পরিবর্তন করে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যারিয়ারে ঢুকেন। শিক্ষকতা ও গবেষণার চেয়ে ভালো কিছু কি আর আছে? গবেষণা করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবেন আর সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দিবেন।
এর চেয়ে আনন্দের কাজ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নাই। এই যে প্রশাসনে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা এটাই প্রমাণ করে আমাদের শিক্ষকরা কতটা অযোগ্য।
প্রশাসনে যেতে পারেন অবসরের পর বা ক্যারিয়ারের একদম শেষ দিকে। আমি দেখেছি পিএইচডি শেষ করেছে খুব বেশি দিন হয়নি অথচ এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে বসে আছে।
তার এই পিএইচডির কি মূল্য আছে? পিএইচডি শেষে ক্লাসে পড়াবে, ছাত্রদের গবেষণা করাবে ও নিজে করবে। তা না করে পদ করে নামের আগে ড. লাগিয়েই এইটাকে অলংকার হিসাবে ব্যবহার করে রাজনীতি আর পদ পদবীর পেছনে দৌড় শুরু হয়ে যায়।
তিনি বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়ে উঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা শুধু পিএইচডি না ন্যূনতম ২ বছরের পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা আছে এবং সেই সময়ের মধ্যে ন্যূনতম ১২ বা তার অধিক প্রকাশিত গবেষণাপত্র আছে তাদের।
অথচ আমাদের দেশের অধ্যাপক হিসেবে প্রমোশনের ন্যূনতম যোগ্যতা ১২টি আর্টিকেল। তাদেরকেই কেবল নিয়োগের জন্য যোগ্য বিবেচনা করা হয়?
আমাদের দেশের কথা ভেবে না হয় পিএইচডি কেউ ন্যূনতম যোগ্যতা ধরতে পারি। অন্তত পিএইচডিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা ধরুন।
তিনি আরও বলেন, দেশের অন্তত প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পোস্ট-ডক নিয়োগের ব্যবস্থা করুন। বিশ্বমানের পোস্ট-ডক নিয়োগ দিতে হলে পোস্ট ডক ফেলোশিপের মানও সেইরকম হওয়া উচিত। ভারতে পোস্ট-ডক বাংলাদেশি টাকায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা সাথে অন্যান্য সুবিধাতো আছেই।আর পিএইচডি ফেলোশিপ ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজার। আর আমার দেশে সহকারী অধ্যাপক পায় ৫০ হাজার টাকা। কি আশা করেন তাহলে। বুঝতে পারছেন যে শিক্ষারমান বাড়াতে হলে গোটা শিক্ষকদের বেতন কাঠামোকেই উপরে তুলতে হবে।
এই জন্যই ইউনেস্কো বলে শিক্ষায় জিডিপির ন্যূনতম ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। পৃথিবীর যেইসব দেশ উন্নত হয়েছে এইটা করেই উন্নত হয়েছে। জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে উন্নত জাতি হওয়ার অলীক স্বপ্ন জাতিকে ধ্বংস করছে।