কামরুল হাসান মামুন
যোগ্যতানুসারে শিক্ষক ও গবেষকদের জন্য একটা স্বাধীন বেতনস্কেল না হলে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন সুদূর পরাহতই থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে অধ্যাপক মামুন এ মন্তব্য করে।
তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো—
গতকাল পরমাণু শক্তি কমিশনে এক আলোচনা সভায়। এই কমিশনের বিজ্ঞানীরা কর্মবিরতি ও আন্দোলনে আছেন অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে। কোন কারণটা বা কারণগুলো এই আন্দোলনকে স্পার্ক করেছে? কমিশনের এক বিজ্ঞানী আমেরিকার ফুল ব্রাইট স্কলারশিপ পেয়েছে। সে ছুটির জন্য দরখাস্ত করেছে কিন্তু তাকে ছুটি দেয়নি। প্রথমত এই কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। তার নিজস্ব নিয়মকানুন আছে। মূলত কমিশনের প্রশাসনই ছুটি দেওয়ার এখতিয়ার রাখে। কিন্তু শুনলাম ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে নাকি কমিশনকে দেখভাল করার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেয়। মন্ত্রণালয় দেখভাল করাকে নিয়ন্ত্রণ মনে করলেন। যাহোক বিজ্ঞানীরা আদালতে গেলেন এবং আদালত তাদেরকে ছুটি দিতে বলেছে। মন্ত্রণালয় আপিল করলেন। মানে তখনও তাদের লজ্জা হয়নি। এই আপিল করাকে কমিশনের বিজ্ঞানীরা ভালোভাবে নেননি। তারা আন্দোলনে নামলেন। আন্দোলনে নামার আরও অনেক কারণ আছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কমিশন যার প্রধান কার্যালয় ভিয়েনায় তারা প্রায়ই নানা কনফারেন্সের আয়োজন করে। কমিশনের প্রশাসন সেই অনুসারে নাম সিলেক্ট করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয় সেখানে হাত ঘুরিয়ে কর্মকর্তাদের নাম ঢুকিয়ে দেয়। কেন তাদেরকে বৈজ্ঞানিক কনফারেন্সে যেতে হবে?
এরমধ্যে তাদের আন্দোলন কয়েকটি টেলিভিশন কভার করেছে। এর একটি ভিডিও দেখার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য হয়েছে। সেখানে এই বিষয়ে এক সাংবাদিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করেন ফুল ব্রাইট পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ পেল তবুও ছুটি দিলেন না। তাকে তো আমাদের সরকারকে কোন টাকা দিতে হতো না। বরং সে যেই টাকা পাবে সেখান থেকে দেশে ডলার আনতে পারবে। সেই কর্মকর্তার উত্তর শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। তিনি বলছেন পোস্ট-ডক কোন ডিগ্রি না। পোস্ট-ডক করলে কোন সার্টিফিকেট পায় না। তাই পোস্ট-ডকের জন্য ছুটি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। হায়রে দেশ। এরা কেবল সার্টিফিকেটই চিনল। সার্টিফিকেট পাইলে সেটা ধরা যায়, ছোয়া যায়। এদের কাছে যা দেখা যায় না, যা ছোয়া যায় না তার কোন মূল্য নাই। অথচ বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানী হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতাই হলো অন্তত একটি দুটি পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা। দুটি থাকলে ভালো কারণ এর মাধ্যমে সে স্বাধীনভাবে, unsupervised গবেষণা করতে সক্ষম কিনা তার একটা লিটমাস টেস্ট। দুঃখজনক হলো খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পোস্ট-ডককে মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ ভারতে যত বছরের পোস্টডক তাকে তত বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞাতর সমান ধরা হয়। আসলে এইটা একটা প্রাপ্তি কিন্তু পোস্টডকের মূল্যই তার চেয়েও বেশি। প্রতি বছর পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ পিএইচডি ডিগ্রি পায়। তাদের সবাই কিন্তু পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ পায় না। এই পাওয়াটা তার পিএইচডির মানকে স্বীকৃতি দেয়। যেমন ভারত থেকে পিএইচডি করে অসংখ্য ছেলেমেয়ে প্রতিবছর বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পোস্ট ডক পাচ্ছে এবং যাচ্ছে। বাংলাদেশে পিএইচডি করে এই ৫৩ বছরের মধ্যে আমি শুনিনি কেউ ইউরোপ আমেরিকায় পোস্ট-ডক পেয়েছেন। আমার জানার ঘাটতি থাকতে পারে। এই থাকাটা হবে ব্যতিক্ৰম।
একটা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় কতটা ভালো বা মন্দ তার একটা লিটমাস টেস্ট হতে পারে সেখানে পোস্ট -ডক ফেলো কতজন। যেমন ভারতের খোদ কলকাতায় অনেকগুলো ইনস্টিটিউট আছে যেখানে শত শত পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো আছে। আর বাংলাদেশে? সারা বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় বা পরমাণু শক্তি কমিশনে একজন পোস্ট-ডক ফেলোও নাই। গবেষণার জন্য একটা ইকো সিস্টেম আছে। এই ইকো সিস্টেমটা কার্যকর না হলে গবেষণা হবে না। সেটা কি? একজন সিনিয়র অধ্যাপক কিংবা বিজ্ঞানী যদি সে এক্টিভ গবেষক হয় তার অধীনে অন্তত একজন পোস্ট-ডক থাকা উচিত। নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ জে রজার্স একজন খ্যাতিমান গবেষক। তার অধীনে ৪০ জন পোস্ট-ডক কাজ করে। প্রিন্সটনের অধ্যাপক আমাদের জাহিদ হাসানের অধীনে অনেকে পোস্ট-ডক কাজ করে। এখন পোস্ট-ডক থাকলেইতো হবে না। সেটা মানসম্মত হতে হবে। আর উন্নতমানের পোস্ট-ডক পেতে হলে ফেলোশিপের মান অন্তত ১ লাখ টাকা হওয়া উচিত যা ভারতে দেয়। অথচ আমাদের একজন অধ্যাপক বেতন পান ১ লাখ টাকা। তাহলে এইটা স্পষ্ট আমরা আসলে এই বেতন স্কেল দিয়ে গবেষণার ইকো সিস্টেম গড়তে পারব না। তাই আমাদের দেশে গবেষণাও হবে না। করতে হলে শিক্ষক ও গবেষকদের জন্য যোগ্যতানুসারে একটা স্বাধীন বেতন স্কেল অবশ্যই লাগবে। যতদিন এইটা না হবে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন সুদূর পরাহতই থাকবে।