পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ভারত | বিবিধ নিউজ

পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ভারত

পাকিস্তানি কৃষক হোমলা ঠাকুর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভারতের পানি বন্ধ করে দেওয়ার খবরে তিনি বলেন, তারা (ভারত) যদি পানি বন্ধ করে দেয়, এগুলো সব থর মরুভূমিতে পরিণত হবে, পুরো দেশ। না খেয়ে মারা যাব আমরা।

#ভারত #পাকিস্তান

ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে সশস্ত্র ব্যক্তিদের হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানের সঙ্গে ঐতিহাসিক সিন্ধু পানি বন্টন চুক্তি বাতিল করেছে ভারত। সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত ওই আন্তর্জাতিক চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তের কারণে এখন প্রশ্ন উঠছে, ভারত কি আসলেই সিন্ধু নদ ও এর আরও দু'টো শাখা নদীর পানির প্রবাহ পাকিস্তানের জন্য বন্ধ করে দিতে পারবে?

এদিকে একতরফাভাবে পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করলে সিন্ধুতে ভারতীয়দের রক্তের স্রোত বইবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। ফলে দুই দেশের মধ্যকার তিক্ততার পারদ প্রতিনিয়তই বাড়ছে।

পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানায়, শুক্রবার সিন্ধু প্রদেশের সুকুর জেলায় পিপিপির এক সমাবেশে সিন্ধু চুক্তি স্থগিতের বিষয়ে ঝাঁজালো ভাষণ দেন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল। তিনি বলেন, ভারত সিন্ধু নদ ডাকাতির চেষ্টা করছে। সিন্ধু সভ্যতার প্রকৃত উত্তরাধিকারীরা পাকিস্তানে বাস করেন। সিন্ধু সভ্যতার বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে পাকিস্তান কখনই নদীর ওপর তার দাবি ত্যাগ করবে না।

আরো পড়ুন: 'সিন্ধুর' পানি ছাড়লো কেন ভারত ?

পেহেলগাম হামলার পর সিন্ধু পানিচুক্তি থেকে ভারত একতরফা সরে আসার প্রতিক্রিয়ায় বিলাওয়াল ভুট্টো বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সভ্যতার উত্তরাধিকার লাভের জন্য চিৎকার করলেও প্রকৃত রক্ষকরা পাকিস্তানের মাটিতেই আছেন। সিতু। আমাদের এবং এটি আমাদেরই থাকবে।

এ সময় ভারতকে সতর্ক করে তিনি বলেন, হয় পানি, না হয় তোমাদের রক্ত এ নদীতেই প্রবাহিত হবে। বিলাওয়াল অভিযোগ করেন, ভারত সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এ হামলার জন্য পাকিস্তানকে দোষারোপ করছে। কোনো প্রমাণ ছাড়াই ভিত্তিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে ভারত অবৈধভাবে সেই চুক্তি বাতিল করছে।

এদিকে শুক্রবার দিল্লিতে এক বৈঠকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, জলশক্তিমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত রঘুনাথ পাতিল ও বিদ্যুৎমন্ত্রী মনোহর লালের কাছে চুক্তি স্থগিতের পর সিন্দু নদীর পানির ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা তুলে ধরেন দেশটির কর্মকর্তারা। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে কীভাবে সিন্ধু অববাহিকার পানি ব্যবহার করা যেতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন উপস্থাপনা তুলে ধরেন তারা।

বৈঠকের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে ভারতীয় জলশক্তিমন্ত্রী সি আর পাতিল বলেন, সিন্ধু নদীর এক ফোঁটাও পানি পাকিস্তানে যেতে দেওয়া হবে না। পোস্টে তিনি আরও বলেন, সিন্ধু পানিচুক্তি নিয়ে মোদি সরকারের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত একেবারেই সঠিক ও জাতীয় স্বার্থে। সিন্ধুর এক ফোঁটা পানিও যেন পাকিস্তানে না যায় সেটি আমরা নিশ্চিত করব।

পেহেলগামে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তে অংশ নিতে পাকিস্তান প্রস্তুত রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। গত শনিবার পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলে এক প্যারেড অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। শাহবাজ শরিফ বলেন, ভারত কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত বা যাচাই প্রমাণ ছাড়াই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা অভিযোগ করেছে।

পাকিস্তান যেকোনো পক্ষপাতহীন, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তে অংশ নিতে প্রস্তুত। একই কথা বলেছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খাজা আসিফ বলেন, পাকিস্তান যেকোনো আন্তর্জাতিক তদন্তে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে। সাক্ষাৎকারে এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

তার অভিযোগ, ভারত এ হামলাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে আইডব্লিউটি চুক্তি স্থগিত করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায় তারা। সিন্ধু নদের পানিকে ভারত কীভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে তার একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে রয়টার্স। ‘নদীর পানি বন্ধের হুমকি ভারতের, পাকিস্তানে আতঙ্ক’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন করেছে রয়টার্স। পাকিস্তানি এক কৃষকের উদ্বেগ সামনে এনে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানি কৃষক হোমলা ঠাকুর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভারতের পানি বন্ধ করে দেওয়ার খবরে তিনি বলেন, তারা (ভারত) যদি পানি বন্ধ করে দেয়, এগুলো সব থর মরুভূমিতে পরিণত হবে, পুরো দেশ। না খেয়ে মারা যাব আমরা।

তিনি জানান, তার প্রায় পাঁচ একরের কৃষিখামার পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লতিফাবাদ এলাকায়, কাছেই সিন্ধু নদ আরব সাগরের দিকে চলে গেছে। এ নদীর উৎপত্তি তিব্বতে আর তা ভারত হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে আরব সাগরে গিয়ে পড়েছে।

ঠাকুরের এ শঙ্কা আরও ১৫ জনেরও বেশি পাকিস্তানি কৃষক ও বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে, বিশেষভাবে কয়েক বছর ধরে যখন বৃষ্টি কমে গেছে।

গত বুধবার ভারত বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে হওয়া সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে। পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ কৃষিজমিতে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করেছে এ চুক্তি। ভারত বলেছে, পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্য ও অপরিবর্তনীয়ভাবে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের প্রতি তাদের সমর্থন বাদ না দেওয়া পর্যন্ত এ চুক্তি স্থগিত থাকবে।

ওই চুক্তি সিন্ধু নদ ও এর শাখা নদীগুলোর পানির প্রবাহকে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে। উভয়পক্ষের সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভারত অবিলম্বে পানির প্রবাহ বন্ধ করতে পারবে না, কারণ চুক্তিতে যে তিনটি নদী পাকিস্তানকে বরাদ্দ করা হয়েছে, ভারত সেগুলোতে বিশাল কোনো জলাধার বা বাঁধ ছাড়া শুধু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করতে পারবে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন শুরু হতে পারে।

সামাজিক মাধ্যম এক্সে ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত রঘুনাথ পাতিল লিখেছেন, সিন্ধু নদের এক ফোঁটা পানিও যেন পাকিস্তানে না যায় তা নিশ্চিত করব আমরা। স্পর্শকাতর বিষয়ে নিয়ে আলোচনার কারণে শনাক্ত হতে অনিচ্ছুক দুই ভারতীয় কর্মকর্তা জানান, ভারত কয়েক মাসের মধ্যেই নিজেদের

কৃষিজমির জন্য খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নেওয়া শুরু করতে পারে আর জলবিদ্যুৎ বাঁধ তৈরির যে পরিকল্পনাগুলো হচ্ছে, সেগুলো শেষ হতে চার থেকে সাত বছর লাগতে পারে।

তাৎক্ষণিকভাবে ভারত তাদের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদীর বিভিন্ন স্থানের পানি প্রবাহের তথ্য ভাগাভাগি করা বন্ধ করে দিয়েছে, বন্যার সতর্কতা দেওয়া স্থগিত করেছে এবং স্থায়ী সিন্ধু কমিশনের বার্ষিক বৈঠক বন্ধ করে দিয়েছে বলে সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের প্রধান হিসেবে অবসর নেওয়া কুশবিন্দর ভোহরা রয়টার্সকে জানিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড পলিসি ম্যানেজমেন্টের টিম লিডার অর্থনীতিবিদ ভাকার আহমেদ বলেছেন, চুক্তি থেকে ভারতের সরে যাওয়ার হুমকিকে পাকিস্তান অবমূল্যায়ন করেছিল।

তিনি বলেন, পানির প্রবাহগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে ধরে রাখার মতো অবকাঠামো ভারতের নেই, বিশেষ করে বন্যার সময়। তাই এ সময়টি পাকিস্তানের জন্য তাদের পানি খাতের অদক্ষতা মোকাবিলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করে। অনেক অদক্ষতা, ফাঁকফোকর আছে।

সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে ফের আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। আর এ দুই দেশ কিশেনগঙ্গা ও রাটেল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পানি সংরক্ষণ এলাকার আকার নিয়ে হেগের স্থায়ী সালিশ আদালতে তাদের কিছু বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করছিল।

গত বৃহস্পতিবার এক চিঠিতে ভারত পাকিস্তানকে জানিয়েছে, চুক্তি যখন স্বাক্ষর হয়েছিল তারপর থেকে পরিস্থিতির অনেক বদলে গেছে, লোকসংখ্যাও অনেক বেড়েছে এবং কার্বন নিঃসরণ করে না জলবিদ্যুতের মতো এমন শক্তি উৎসের চাহিদাও বেড়েছে। অবশ্য বিশ্বব্যাংকের এক মুখপাত্র বলেছেন, ব্যাংক সীমিত নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য করা চুক্তিটির স্বাক্ষরকারী ছিল আর এটি সদস্য দেশগুলোর চুক্তি সম্পর্কিত সার্বভৌম সিদ্ধান্তের ওপর মতামত দেয় না।

সিন্ধুতে নাদিম শাহর দেড়শ একরের একটি কৃষিখামার আছে। সেখানে তিনি তুলা, আখ, গম ও শাকসবজির চাষ করেন। তিনি শুধু সেচের পানি না, পানযোগ্য পানি নিয়েও উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। তিনি বলেন, খোদার ওপর আমাদের বিশ্বাস আছে, কিন্তু ভারতের পদক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

#ভারত #পাকিস্তান