ইরানের তুরুপের তাস হরমুজ প্রণালি | বিবিধ নিউজ

ইরানের তুরুপের তাস হরমুজ প্রণালি

পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে হরমুজ প্রণালি বন্ধের প্রস্তাব পাস করেছে ইরানের পার্লামেন্ট।

#ইরান #ইরান ইসরাইল উত্তেজনা #ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ #ইরানের খবর #যুক্তরাষ্ট্র ইরান সংঘাত

পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে হরমুজ প্রণালি বন্ধের প্রস্তাব পাস করেছে ইরানের পার্লামেন্ট। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র হুঁশিয়ারি দিয়েছে, বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্যিক পথটি বন্ধ করা হবে ইরানের ‘অর্থনৈতিক আত্মহত্যা’। ইরানের ‘তুরুপের তাস’ বলা হয় বিশ্ব বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রণালিকে।

ইরানের মজলিসে শূরা-ই ইসলামির (পার্লামেন্ট) জাতীয় নিরাপত্তা কমিশনের সদস্য মেজর জেনারেল কাউসারি জানিয়েছেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়ে পার্লামেন্ট নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদসুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল।

হরমুজ প্রণালি একটি ভূরাজনৈতিক চোক পয়েন্ট

বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুট হিসেবে বিবেচিত হরমুজ প্রণালি পারস্য উপসাগরকে সংযুক্ত করেছে ওমান উপসাগরের সঙ্গে। এই সংকীর্ণ জলপথটির প্রস্থ সর্বনিম্ন স্থানে মাত্র ৩৩ কিলোমিটার এবং এর মধ্যে জাহাজ চলাচলের জন্য ব্যবহারযোগ্য চ্যানেলের প্রস্থ প্রায় ২ কিলোমিটার।

বিশ্বের প্রতিদিনের সমুদ্রপথে রপ্তানিকৃত তেলের প্রায় ২০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২১ মিলিয়ন ব্যারেলএই প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত হয়। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরানসহ বহু তেলসমৃদ্ধ দেশের জ্বালানি রপ্তানি এই রুটের ওপর নির্ভরশীল। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, চীন, জাপান, ভারত, বাংলাদেশসহ এশিয়া ও ইউরোপের বহু দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য হরমুজ প্রণালি অবিচ্ছেদ্য।

এই জলপথটি এতটাই কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে যে বিশ্লেষকরা একে ‘চোক পয়েন্ট’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেনএকটি এমন পথ, যা বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ব অর্থনীতির শ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যবৃদ্ধি, সংকট ও অস্থিরতা

ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়, তাহলে তা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই হবে বিপর্যয়কর। বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বিপুলভাবে বাড়িয়ে দেবে, যার প্রথম আঘাত লাগবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে। ট্যাংকারের বীমা ও শিপিং খরচ অসাধারণ হারে বেড়ে যাবে, ফলে অন্যান্য পণ্যের দামেও প্রভাব পড়বে। চীন, ভারত, বাংলাদেশসহ বহু দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে। বিকল্প কোনো কার্যকর রুট না থাকায় এই প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ব সরবরাহ চেইন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এ ছাড়া, হরমুজের পাশাপাশি আরেকটি কৌশলগত প্রণালি হলো বাব আল-মানদাব, যা লোহিত সাগরের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত এবং বর্তমানে হুতি মিলিশিয়াদের প্রভাবাধীন। এই দুটি প্রণালি একসঙ্গে বন্ধ হয়ে গেলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সামুদ্রিকবাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

হরমুজ প্রণালি কীভাবে বন্ধ করতে পারে ইরান

বিশ্লেষকদের মতে, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার মতো সামরিক সক্ষমতা ইরানের রয়েছে। ইরান চাইলে প্রণালিতে সামুদ্রিক মাইন বসিয়ে, স্পিডবোট ও ড্রোন হামলার মাধ্যমে কিংবা জাহাজ জব্দ করে চলাচল বিপর্যস্ত করতে পারে। এ ছাড়া, ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে বিদেশি ট্যাংকারে আঘাত হানার ক্ষমতাও তাদের আছে। ইলেকট্রনিক জ্যামিং ও রাডার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আকাশ ও সমুদ্রপথও তারা অস্থির করে তুলতে পারে। তবে অনেক সময় ইরান শুধু মুখে ‘প্রণালি বন্ধের হুমকি’ দিয়েই কার্যত বাণিজ্যিক চলাচলে প্রভাব ফেলে যেটিকে কৌশলগত ভয় দেখানো বা চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ও কূটনৈতিক চাপ

পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা ইরানকে প্রভাবিত করে হরমুজ প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও একে ‘অর্থনৈতিক আত্মহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করে বলেন, এতে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, চীন নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ চীনের জ্বালানির একটি বিশাল অংশ এই প্রণালি হয়ে আসে।

ইরানের কৌশল

ট্রাম্প কার্ড না ব্লাফ বিশ্লেষকদের মতে, হরমুজ প্রণালি ইরানের কূটনৈতিক ‘ট্রাম্প কার্ড’। ইরান জানে, এই প্রণালি বন্ধ করা মানেই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিস্ফোরণ ঘটানো। ঠিক যেমন কোনো খেলোয়াড় জয়ের আগে শেষ চাল দেয়, তেমনই ইরান এখন হিসাব কষছেএই কার্ড এখনই খেলবে, না কেবল ভয় দেখিয়ে কূটনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে।

তবে এটাও সত্য, এত বড় সিদ্ধান্তে ইরান একা নয়। অনেক দেশ ও কূটনৈতিক শক্তি এখন বিষয়টি থামিয়ে রাখতে চাইছে। আর ইরানও এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সমীকরণ ও প্রতিক্রিয়াগুলো পর্যবেক্ষণ করে ধীরে এবং কৌশলগতভাবে এগোচ্ছে।

#ইরান #ইরান ইসরাইল উত্তেজনা #ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ #ইরানের খবর #যুক্তরাষ্ট্র ইরান সংঘাত