এআই জেনারেটেড প্রতীকী ছবি
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শিশুশ্রম বন্ধ করতে কর্মসূচি গ্রহণ করে সেই সুবাদে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুন থেকে প্রতিবছর বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ বছর ১২ জুন সরকারি ছুটি থাকায় সরকার এ দিবস পালন করা হয় ১৯ জুন। এবছরের প্রতিপাদ্য – ‘স্বপ্নের ডানায় ভর করি, শিশুশ্রমের শৃঙ্খল ছিঁড়ি, এগিয়ে চলি দৃপ্ত পায়ে, আশার আগুন বুকে জ্বালি।
দেশে প্রায় ৩৫ লাখ শিশুশ্রমিক রয়েছে এবং ১০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এ তথ্য জানিয়ে শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, শিশুশ্রম প্রতিরোধে শিশুদের কাজে নিয়োগ করা ব্যক্তিদের শাস্তি কয়েকগুণ বাড়ানো হবে। সেইসঙ্গে পরিবর্তন করা হবে শিশুশ্রমের সংজ্ঞা।
তারই ধারাবাহিকায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভা, র্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, যারা ৫-১৪ বছর বয়সী শিশু যাদের বেতন বা অবৈতনিক উভয় ক্ষেত্রে দৈনিক এক বা একাধিক ঘণ্টা কাজ করে তাদের শিশু শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে জাতিসংঘ শিশু জরুরি তহবিল (ইউনিসেফ) শিশুশ্রমকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করে যা শিশুর স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে প্রভাবিত করে। যদি শিশুশ্রমটা আটকানো না যায় তাহলে স্বপ্ন দেখা শিশুর স্বপ্নগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ধারায় শিশুদের সুবিধা প্রাপ্তি-সংক্রান্ত বিশেষ আইন রয়েছে; যা শ্রম আইন ২০০৬ নামে পরিচিত। এতে বলা রয়েছে কাজে যোগদানের কমপক্ষে বয়স ১৪ বছর আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে ১৮ বছর। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ১৪ বছর হওয়ার আগেই শিশুদের বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে; তাছাড়া একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য যেসব কাজ ঝুঁকিপূর্ণ সেসব কাজে কোমলমতি শিশুদের নিয়োগ করা হচ্ছে, যা মোটেও উচিত নয়।
এর একটি প্রধান কারণ হলো, শিশু শ্রমিকদের তুলনামূলকভাবে কম মজুরি দিয়ে কাজ করানো যায়। তাই নিয়োগকারীরা শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগায় এবং কাজ বেশি করিয়ে নেয়। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন ২০১৮-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে, এতে বলা হয়েছে কেউ যদি শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেয় তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। কিন্তু অশিক্ষা, অসচেতনতা এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে শিশুশ্রম মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে প্রধান বাধা। তাই শিশুশ্রম রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।কথায় আছে ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।’ বর্তমানে কথাটির যথার্থতা কি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্ধমান আছে? নিঃসন্দেহে সংকোচিত হয়ে পড়েছে তার ব্যপকতা। কারণ বর্তমান সময়ে শিশু শ্রম একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিরাট একটি অংশ নিজেদের সক্রিয়তা হারাতে বসেছে।
জাকির আহমদ খান কামাল
অসচ্ছল পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের ভরণপোষণ ও শিক্ষার খরচ মেটাতে পারে না, তাই শিশুরা কাজে যেতে বাধ্য হয়। পরিবারের আর্থিক সংকট শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য করে, কারণ তারা মনে করে যে তাদের কাজ করা দরকার পরিবারের জন্য।
অনেক ক্ষেত্রে, শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না এবং তাদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকে না, যার ফলে তারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়। সমাজের কিছু অংশে শিশুদের কাজ করাকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা হয় এবং তাদের শিক্ষার চেয়ে কাজকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।
কিছু ক্ষেত্রে, শিশুদের প্রতি অবহেলা বা তাদের প্রতি যত্ন না থাকার কারণেও তারা শিশুশ্রমে লিপ্ত হতে পারে। অনেক সময়, শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য যে আইন ও নীতি রয়েছে, সেগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় না, যা শিশুশ্রমের একটি কারণ।
বাস্তবতার কাছে হার মানতে হচ্ছে অসচ্ছল পরিবারগুলো। তাই পরিবারের দায়িত্ব শিশুদের কাঁধে তুলে দিয়ে অভিভাবকরা নিজেদের শিশুদের কাজে লাগিয়ে নিজেদের অজান্তেই এদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তারা কল-কারখানা থেকে শুরু করে পাথর ভাঙা, মানুষের বাসাবাড়ি নির্মাণ, বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, গাড়ির গ্যারেজসহ অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) গত ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালন করেছে। আইএলও ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে ওই দিন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, বৈশ্বিক প্রচেষ্টার ফলে শিশুশ্রম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বে প্রায় ১৩ কোটি ৮০ লাখ শিশুশ্রমে যুক্ত ছিলো, যার মধ্যে ৫ কোটি ৪০ লাখ শিশুই ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এ কারণে তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের হার ছিলো ৩ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে তা কমে ২ দশমিক ৭ শতাংশ (প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু) হয়েছে। তবে একই সময়ে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শ্রমে যুক্ত থাকার সামগ্রিক হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে সামান্য বেড়ে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। ক্ষতিকর কাজে যুক্ত শিশুশ্রমের হারও ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
ইউনিসেফের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে গত দুই দশকে বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়ায় বাংলাদেশের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যে পৌঁছানোর সঠিক গতিতে নেই বাংলাদেশ। শ্রমে যুক্ত অধিকাংশ শিশু কাজ করছে অনানুষ্ঠানিক খাতে, যেখানে তারা দীর্ঘ সময় ধরে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। শিশুশ্রম শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। এটি তাদের শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে সীমিত করে দেয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে
পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হলে শিশুশ্রমের সংজ্ঞা পরিবর্তন এবং শিশুদের কাজে নিয়োগকারী ব্যক্তিদের শাস্তি কয়েকগুণ বাড়ানো দরকার। সংজ্ঞা পরিবর্তন ও শাস্তি বৃদ্ধি শিশুশ্রম প্রতিরোধে কতটুকু সহায়ক হবে তা বুঝা সময় সাপেক্ষ। তবে সবার আগে দরকার মানসিকতার পরিবর্তন ও প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ। পাশাপাশি দারিদ্র্য নিরসন, শিক্ষার প্রসার, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, হতদরিদ্র পরিবারগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা দান ও শিশু অধিকার সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর সঠিক প্রয়োগ জরুরি। সেক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি পরিবার, সমাজ এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: শিক্ষক ও কলাম লেখক