প্রতিষ্ঠান প্রধানছাড়া মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব? | শিক্ষাবিদের কলাম নিউজ

প্রতিষ্ঠান প্রধানছাড়া মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব?

একটা বিদ্যালয়ে যদি প্রধান শিক্ষক না থাকেন তার অর্থ হচেছ, ঐ বিদ্যালয়ে দাপ্তরিক কাজ, ক্লাস মনিটরিং, রিপোর্ট তৈরি, রুটিন অনুযায়ী ক্লাস পরিচালনা, শিক্ষা অফিসে দৌড়াদৌড়িসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কাজগুলো সঠিকভাবে হয়না এবং আগায়না। আর এসব পদে চলতি দায়িত্বে থাকা প্রধানদের কথা অন্যান্য শিক্ষকরা তেমন মানতে চাননা।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষাদান নিয়ে প্রশ্ন বহুদিনের। এটা সত্য, এ পর্যায়ের চাকরিটা সরকারি হওয়ায় বর্তমানে অনেক সম্ভাবনাময় প্রার্থী এ পর্যায়ের শিক্ষকতায় আসছেন। যদিও তাদের ধরে রাখার তেমন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আর সরকারি নিয়ম কানুনের গ্যাঁড়াকলে দীর্ঘদিন ধরে দেশের বহুসংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। বহু উপজেলা ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে নেই শিক্ষা অফিসারসহ অন্যান্য পদের কর্মকর্তা। ফলে, মানসম্মত শিক্ষাদানে এক বিরাট বাঁধার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারিভাবে পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ব্যাক্তিপর্যায়ে পরিচালিত বলে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়। যেটি সরকারিতে সম্ভব হয় না। কারণ এখানে রয়েছে বহু প্রটোকল, বহু নিয়ম কানুন। আর ট্রাডিশনাল দীর্ঘসূত্রতার বিষয় তো সরকারি কাজকর্মে রয়েছেই। এসব কারণে একটু সচছল শ্রেণির অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতে চাননা।

একটা বিদ্যালয়ে যদি প্রধান শিক্ষক না থাকেন তার অর্থ হচেছ, ঐ বিদ্যালয়ে দাপ্তরিক কাজ, ক্লাস মনিটরিং, রিপোর্ট তৈরি, রুটিন অনুযায়ী ক্লাস পরিচালনা, শিক্ষা অফিসে দৌড়াদৌড়িসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কাজগুলো সঠিকভাবে হয়না এবং আগায়না। আর এসব পদে চলতি দায়িত্বে থাকা প্রধানদের কথা অন্যান্য শিক্ষকরা তেমন মানতে চাননা।

শিক্ষা অফিস সূত্রে থেকে জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় বিগত ২৫ বছরে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কোনো কর্মচারী নিয়োগ হয়নি। ফলে মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলো স্বাভাবিক কাজ পরিচালনা করতে প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হচেছ। এছাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে বিগত ১০ বছরে কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি। প্রধান শিক্ষক পদে তিন ভাগের দুই ভাগ সহকারী শিক্ষক থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হতো। বাকি এক ভাগ সরাসরি নিয়োগ হতো। তবে মামলা জটিলতায় সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির বিষয়টি প্রায় দশ বছর ধরে ঝুলে আছে। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে পদগুলো চলতি দায়িত্ব দিয়ে চালাতে হচেছ। অন্যদিকে নিয়োগবিধিতে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে ৫০ শতাংশ সরাসরি নিয়োগের বিধান থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে সরাসারি নিয়োগ দেয়া হচেছ না। এসব কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রশাসনিক ও একাডেমিক দুই ধরনের কাজই বাধাপ্রাপ্ত হচেছ।

দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখলাম, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ২২৯টি। এর মধ্যে ৬১টি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। সহকারী শিক্ষকের পদ খালি ১১০টি। এসব বিদ্যালয় তদারকির জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে একজন শিক্ষা কর্মকর্তা, আটজন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে নয়টি পদেও বিপরীতে আছেন কেবল একজন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা। যিনি এখন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকতা। উপজেলার সব প্রাথমিক বিদ্যালয় একাই তদারকি করতে হচেছ তাকে। এ ছাড়া উপজেলায় একজন উচচমান সহকারী, তিনজন অফিস সহকারী ও একজন পিয়নের পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুজন। একই চিত্র পটিয়া উপজেলায়ও। এই উপজেলায় ১৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রধান শিক্ষক নেই ৫৭টি বিদ্যালয়ে। সহকারী শিক্ষক পদ খালি ৯৩টি। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে একজন শিক্ষা কর্মকর্তা ও আটজন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র একজন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা। এখানেও তাকে একাই সামলাতে হচেছ সব কার্যক্রম।

কেবল এই দুই উপজেলায় নয়, কাছাকাছি চিত্র চট্টগ্রামের অন্য উপজেলাগুলোতেও। চট্টগ্রামে ২ হাজার ২৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৭৯২টি বিদ্যালয় চলছে প্রধান শিক্ষক ছাড়াই। এসব বিদ্যালয়ে ১৩ হাজার ৫৯৯টি সহকারী শিক্ষকের পদের মধ্যে বর্তমানে শূন্য আছে এক হাজার ৩৬২টি। ফলে জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হচেছ শিক্ষা কার্যক্রম। প্রধান শিক্ষক না থাকায় সহকারী শিক্ষকদের দাপ্তরিক কাজে সময় বেশি দিতে হচেছ। এতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচেছ।

এ ধরনের চিত্র দেশের সর্বত্র। সরকারি পর্যায়ে বিষয়টি নিয়মিত তদারকী ও আপডেট করার ব্যবস্থাও অনুপস্থিত। বেসরকারি পর্যায়ে এবং শিক্ষা সাংবাদিকদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণে এ ধরনের সংবাদ আমরা প্রায়ই পেয়ে থাকি।

একটি বিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শৃংখলা সঠিক রাখতে হলে প্রধান শিক্ষকের পদ কোনভাবেই দীর্ঘদিন খালি রাখা ঠিক নয়। ক্লাস ব্যবস্থাপনা, শিক্ষকদের উপস্থিতি, শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি দেখভাল করার কেউ থাকেনা যদি প্রধান শিক্ষকই না থাকেন। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পদ খালি থাকলেও মানস্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়না , অথচ এই অবস্থাগুলোই চলছে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে। প্রাথমিক পর্যায়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে দ্রুত সময়ের মধ্যে শূন্যপদ পূরণ করা আবশ্যক। গ্রামেগঞ্জে যেসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, সেগুলোর বেহাল অবস্থা। সেখানে প্রধান শিক্ষক অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন। প্রাথমিক শিক্ষার মান, কম শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়া, যারা ভর্তি হন তাদের মধ্যে কাঙ্খিত যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন না প্রায় নব্বই শতাংশ শিক্ষার্থী---এসব আলোচনা অহরহই হচেছ। কিন্তু মূল জায়গাগুলো আমরা এড়িয়ে যাচিছ কিংবা গুরুত্ব কম দিচিছ। যা দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে এক বেহাল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। এর উত্তরণ আশু প্রয়োজন।

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক