ছাত্রীকে যৌন হয়রানি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একাধিক অভিযোগে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) দুই শিক্ষককে পদাবনতি করা হয়। তদন্ত রিপোর্ট ও সিন্ডিকেট বোর্ডের সভার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে, এবার অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের পক্ষে সাফাই গাইলেন সিন্ডিকেট সদস্য ও মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন সরকার। অভিযুক্তদের শাস্তি মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে দাবি করে কুবির রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দিয়েছেন তিনি। ওই চিঠিতে শাস্তি পুর্নবিবেচনার সুপারিশও করেন তিনি।
পদাবনতি শিক্ষকরা হলেন, কুবির ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলী রেজওয়ান তালুকদার এবং ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দিন।
এদিকে, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন সরকারের চিঠির জেরে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে শুরু হয়েছে সমালোচনা। অভিযুক্তদের পক্ষে সাফাই গেয়ে তিনি শিক্ষকতার নৈতিক ভিত্তি ক্ষুণ্ন করেছেন বলে মন্তব্য করছেন একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী। তাদের দাবি, এ ধরণের অবস্থান সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তার উপযুক্ততা নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
জানা যায়, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজি বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে তৎকালীন বিভাগীয় চেয়ারম্যান আলী রেজওয়ান তালুকদারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, রেজওয়ান তালুকদারের অনৈতিক প্রস্তাবের সকল বিষয়ের তথ্য ভুক্তভোগীর ফোনে ছিল। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে ওই ছাত্রীর ফোনের সিমকার্ড পরিবর্তন ও মেমোরি নষ্ট করে ফেলেন তিনি।
ভুক্তভোগী ছাত্রীর দাবি, শিক্ষক রেজওয়ান আগেও তাকে বিভিন্ন সময় নিজের কক্ষে বা বাসায় আসার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং ক্লাসে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন।
অভিযুক্ত আরেক শিক্ষক জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, জসিম উদ্দিন বিবাহিত নারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ক্লাসে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করেন। এক শিক্ষার্থীকে বলেন, ‘জামাইয়ের সঙ্গে থাকতে থাকতে বালতি হয়ে গেছো।’ আবার ঢাকায় থাকার কারণে এক শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকায় তাকে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে বলেন, ‘তুমি ঢাকা ছিলা, তোমাকে খুললো কে?’
২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ আগস্ট বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের চতুর্থ সেমিস্টারের ‘বিজনেস স্ট্যাটিস্টিকস’ কোর্সের ভাইভা চলাকালে এক ছাত্রী পর্দা করায় তাকে ‘মৌলবাদী জঙ্গি’ বলে আখ্যায়িত করেন জসিম উদ্দিন। সেই শিক্ষার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় ‘ম্যানার’ না জানার অজুহাতে অপমানও করেন তিনি।
অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট সাপেক্ষে ও সিন্ডিকেট সভায় আলোচনার মাধ্যমে অভিযুক্ত দুই শিক্ষককে সম্প্রতি শাস্তিস্বরূপ পদাবনতি দেওয়া হয়।
সম্প্রতি রেজিস্ট্রার দপ্তরে জমা দেওয়া চিঠিতে অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের পক্ষে সাফাই গেয়ে আমজাদ হোসেন লেখেন, অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট সভায় যে শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা ‘মাত্রাতিরিক্ত’ ও কিছু শাস্তির বিষয়ে সিন্ডিকেটে আলোচনা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অনেকেই আমজাদ হোসেনের এ অবস্থানকে যৌন হয়রানিকে আড়াল দেওয়ার স্পষ্ট প্রয়াস হিসেবে দেখছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন সিন্ডিকেট সদস্য হয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্তদের পক্ষে কথা বলা যেমন অনৈতিক, তেমনি এটি ভুক্তভোগীদের প্রতি চরম অসম্মান।
কুবি প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ জুন রেজিস্ট্রার বরাবর আমজাদ হোসেন চিঠিটি দেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ১০৩ তম সিন্ডিকেট সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানে আলোচ্যসূচী-২৭ ও ৩১-এর অধীনে যথাক্রমে সহযোগী অধ্যাপক আলী রেজওয়ান তালুকদার ও সহকারী অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা নিয়ে তার আপত্তি রয়েছে। তার দাবি, তদন্ত প্রতিবেদন সম্পূর্ণভাবে সভায় পঠিত হয়নি এবং কিছু শাস্তির বিষয়ে সভায় কোনো আলোচনাও হয়নি।
চিঠিতে আমজাদ হোসেন আরও বলেন, অভিযুক্ত আলী রেজওয়ান তালুকদারের বিরুদ্ধে আনীত মোবাইল সিম ও মেমোরি কার্ড অপসারণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এবং যৌন হয়রানির প্রমাণও যথেষ্ট নয়। একইভাবে জসিম উদ্দিনের ক্ষেত্রেও যৌন হয়রানি প্রমাণিত হয়নি। শুধুমাত্র পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে অসতর্কতা ও বডি শেমিং এর কিছু লক্ষণ পাওয়া গেছে। এ প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি তাদের যে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তা মাত্রাতিরিক্ত।
তবে, সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্য বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, সিন্ডিকেটে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই নেওয়া হয়েছে ও সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে নেওয়া হয়নি বরং সব সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে।
এ বিষয়ে সিন্ডিকেট সদস্য উপউপাচার্য ড. মাসুদা কামাল বলেন, ‘সাধারণত সিন্ডিকেট সভায় পর্যালোচনা ও মতামতে মাধ্যমেই যে কোনো সিদ্ধান্ত আসে। সেই অনুযায়ী অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের বিষয়েও পর্যালোচনার মাধ্যমে শাস্তির সিদ্ধান্ত এসেছে।’
সিন্ডিকেট সদস্য প্রক্টর আব্দুল হাকিম বলেন, ‘আমি সিন্ডিকেট সভয় উপস্থিত ছিলাম। সকল সিন্ডিকেট সদস্যদের মতামত ও পর্যালোচনার মাধ্যমেই তাদের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে।’
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিয়োগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।