‘মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ’ | মতামত নিউজ

‘মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ’

বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নতুন নাম ‘কাপাসিয়া সরকারি ডিগ্রি কলেজ’। স্বাধীনতার দীর্ঘ অর্ধশতক বেশি সময়ের পার হলেও আমার লেখার শিরোনামটির সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ।

বাংলাদেশের ৩৭ জেলার ৬৮টি সরকারি কলেজের নাম পরিবর্তন করে সম্প্রতি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। তার মধ্য রয়েছে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় উপজেলায় অবস্থিত শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরকারি কলেজর নাম।

বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নতুন নাম ‘কাপাসিয়া সরকারি ডিগ্রি কলেজ’। স্বাধীনতার দীর্ঘ অর্ধশতক বেশি সময়ের পার হলেও আমার লেখার শিরোনামটির সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। আজ মনে হচ্ছে তিনি আজকের জন্যই বুঝি এমন লেখা লিখে গেছেন, যা তিনি তার নিজস্ব দর্শন দিয়ে আগেই বুঝেছিলেন।

আজ তাজউদ্দীন আহমদের আরেকটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ছে। ‘আমি দেশের জন্য এমনভাবে কাজ করবো যেনো দেশের ইতিহাস লেখার সময় সবাই এদেশটাকেই খুঁজে পায়, কিন্তু আমাকে হারিয়ে ফেলে’। তাহলে সত্যিই আমরা স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদকে হারাতে বসেছি?

জুলাই অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-জনতা যখন অন্য সব মূর্তি ভেঙে ফেলছিলো সেই সময় তাজউদ্দীন আহমদের মূর্তিতে ছাত্র-জনতা ফুলের মালা পরিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলো। বর্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ইতিতাসে এটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও বিরল নজির।

পৃথিবীর অধিকাংশ স্বাধীন দেশ বা রাজবংশ প্রতিষ্ঠায় নেপথ্যে একজনের অগ্রণী ভূমিকা বিদ্যমান থাকে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে হযরত আবুবকর (রা.), উমাইয়া খিলাফতে আমর বিন আস, আব্বাসীয় খিলাফতে আবু মুসলিম খোরাসানী, ফাতেমীয় খিলাফতে আবু আবদুল্লাহ খিলাফত তথা স্বাধীন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখে গেছেন, তদ্রুপ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠায় তাজউদ্দীন আহমদ তেমনই একজন দক্ষ কারিগর ও সংগঠক। ইতিহাসে লেলিনের ঘনিষ্ঠ সহচর ট্রটস্কি ও সুলতান সোলেমানের ইব্রাহিম পাশার মতই বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ও বাংলার নেপথ্যে কারিগর ছিলেন বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ।

কাপাসিয়ার উর্বর ও লাল মৃত্তিকার অপূর্ব সমন্বয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী এক নৈসর্গিক ও নান্দনিক পরিবেশ কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রাম। শীতলক্ষ্যার শীতল হাওয়া ও বয়ে যাওয়া কলকল ঢেউয়ের সঙ্গে পাখ পাখালির ডাক চির সবুজের এ গ্রাম ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে চিরদিন। কেনোনা এখানেই স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৌলবী মুহাম্মদ ইয়াসিন খান এবং মাতা মেহেরুন্নেছার চার ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন চতুর্থ।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি ভারতের সহায়তায় মুজিবনগর সরকার গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কে স্বাধীন করার জন্য দক্ষ নাবিকের ভূমিকা পালন করেন। তিনিই একমাত্র রাজনীতিবিদ দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নাই। তাজউদ্দীন আহমদ যদি ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে যদি ভারতে না যেতেন তবে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়ত ভিন্নভাবে লিখা হতো।

সাদামাঠা তাজউদ্দীন আহমদ : তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হলেও তাকে ভোগ বিলাসিতা স্পর্শ করতে পারেনি। রাজনীতির ইতিহাসের অন্যতম বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন সৃষ্টি করে গেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি একটি মাত্র বুশ শার্ট পরিধান করে দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করেছেন। রাতে তার বুশ শার্ট নিজে ধুয়ে ফ্যানের নিচে রেখে শুকিয়ে পরের দিন আবার পরিধান করতেন। অফিসের পিয়ন অসুস্থ হলে তাকে সশরীরে দেখতে যাওয়ার নজিরও রয়েছে।

রাজনীতিতে ভিন্ন মতাদর্শী থাকা স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া যা সভ্য যেকোনো দেশেই রয়েছ তবে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদকে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শীর জন্য দায়ী করে বর্তমানে তা সঠিক হবে বলে মনে করে না অনেকেই। রাজনীতিতে ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে কেউ নয় সে হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদও ভুলের উর্ধ্বে নয়। তাই নাম পরিবর্তনের বিষয়টি সুবিবেচনা করা অতীব জরুরি। অন্যথায় তাজউদ্দীন আহমেদের কথাটি হয়তবা সত্যি হতে যাচ্ছে ‘মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ’।

লেখক: লেকচারার, ভাওয়াল মির্জাপুর কলেজ, গাজীপুর।

(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)