স্থানীয় আইনজীবী সমিতির সদস্য মো. আবু তৈয়বের করা মামলায় আহমেদ কাওছার বিন জামান নামের এক প্রভাষকের জামিন মঞ্জুর করেছেন লক্ষ্মীপুরের আদালত।
যার কারণে জামিন মঞ্জুরকারী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট বর্জনের ডাক দিয়েছে লক্ষ্মীপুর আইনজীবী সমিতি।
এ দিকে সমিতির সদস্যের প্রতিপক্ষের হয়ে আদালতে শুনানি করতে আসা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে এজলাস কক্ষেই হেনস্তা করা হয়। এতে আদালতেই অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে তাৎক্ষণিক লক্ষ্মীপুরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন।
জানা গেছে, সমিতির অলিখিত সিদ্ধান্ত অনুসারে সংগঠনের কোনো সদস্যের প্রতিপক্ষের হয়ে সমিতির অন্য কোনো সদস্য আদালতে দাঁড়াবেন না। যে কারণে এই শিক্ষকের জামিন আবেদনের পক্ষে কোনো আইনজীবী আদালতে দাঁড়াতে রাজি হননি।
শেষে আইনজীবী মোরশেদ আলম শিক্ষকের পক্ষে আদালতে দাঁড়ালে এজলাস কক্ষেই তাকে হেনস্তা করা হয়। এজলাস কক্ষে সমিতির সম্পাদক মো. রফিক উল্যাহর নেতৃত্বে মোরশেদ আলমকে অপদস্ত করা হলে তিনি সেখানেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এদিকে আইজীবীকে শুনানি করতে না দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রভাষকের ভাই ও অন্য আসামির স্বজনরা আদালতে জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন। শুনানি নিয়ে আদালত প্রভাষকসহ অন্য আসামির জামিন মঞ্জুর করেন। এজলাস কক্ষে উপস্থিত লোকজনের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এজলাস কক্ষে আইনজীবীকে হেনস্তা করে তাকে শুনানি করতে না দিলেও জামিন মঞ্জুর হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেটকে উদ্দেশ করে এজলাস কক্ষেই অশোভন শব্দচয়ন করা হয়। এমনকি 'কীভাবে এজলাসে ওঠেন, দেখে নেব' বলেও ম্যাজিস্ট্রেটকে হুমকি দেওয়া হয়।
কোনো আইনজীবীর প্রতিপক্ষের হয়ে অন্য আইনজীবী আদালতে লড়বেন না- আইনজীবী সমিতির এমন অমানবিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও আছেন অনেক আইনজীবী। তারা বলছেন, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার সবার আছে।
তবে সমিতির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ উঠতে পারে- এমন আশঙ্কায় এই বিষয়ে উদ্ধৃত হতে চান না কেউ। তারা বলছেন, এই চর্চার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আইনজীবী মোরশেদ আলম মবের শিকার হয়ে বর্তমানে হৃদরোগে আক্রান্ত।
এরপর বর্তমানে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামও তোপের মুখে আছেন। কারণ তার কোর্ট বর্জনের ডাক দিয়েছে সমিতি। কোর্ট খোলার পর আগামী সোম-মঙ্গলবার থেকে এমন কিছু করা হতে পারে, যাতে আইনজীবীর প্রতিপক্ষের হয়ে কোনো আইনজীবী শুনানি করতে চাইলেও ভবিষ্যতে আদালত তাদের শুনানি না নেন।
আইনজীবী মো. আবু তৈয়বের করা মামলায় গত ১০ জুন মঙ্গলবার মঞ্জুর করা ওই জামিন আদেশে লেখা হয়, আসামিদের জামিনের প্রার্থনায় উল্লেখ করেন ফরিয়াদি (মামলার বাদী) বিজ্ঞ আইনজীবী। সেই জন্য লক্ষ্মীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির কোনো বিজ্ঞ সদস্য আসামি পক্ষে জামিন শুনানি করতে ইচ্ছুক নন। ১ নম্বর আসামি আহমেদ কাওছার বিন জামান একজন প্রভাষক। তিনি প্রিন্সিপাল কাজী ফারুকী কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক। ফরিয়াদি ও আসামিদের মধ্যে একাধিক মামলা রয়েছে।
জামিন আদেশে উল্লেখ করা হয়, ফরিয়াদির এজাহারে বর্ণিত মতে ফরিয়াদি এবং আসামিদের মধ্যে পূর্ববিরোধ রয়েছে। পূর্ববিরোধ থাকায় গেট চুরির অভিযোগ আলংকারিক হতে পারে। এজাহার পর্যালোচনায় অত্র মামলায় অপরাধ ক্ষতিসাধনের অপরাধ হিসেবে আপাতদৃষ্টে দৃষ্টিগোচর হয়। ফৌজদারি কার্যবিধিতে ক্ষতিসাধনের অপরাধ একটি জামিনযোগ্য ধারার অপরাধ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
জামিন মঞ্জুরের আদেশে আরও উল্লেখ করা হয়, লক্ষ্মীপুর লিগ্যাল অফিস সূত্রে জানা যায়, আসামি পক্ষ আইনজীবী না পেয়ে জামিনের শুনানির জন্য লিগ্যাল এইড অফিসে আইনগত সহায়তা চান। লিগ্যাল এইড অফিস থেকে বিজ্ঞ আইজীবী হাবিবুর রহমান এবং বিজ্ঞ আইনজীবী রিনা পারভীনকে জামিন শুনানি করতে বলা হলে তারা জামিন শুনানি করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। জামিন শুনানি করলে তাদের শারীরিকভাবে হেনস্তা করা হতে পারে মর্মে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
আদেশে বলা হয়, যে গেটের ক্ষতিসাধন হয়েছে মর্মে ফরিয়াদি মামলা করেছে সেই গেট উদ্ধার হয়েছে। মর্মে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। তা ছাড়া ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১৪ জুন পর্যন্ত আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। আসামিরা গ্রেপ্তারের দিন জামিন শুনানির সুযোগ পাননি।
আসামিদের চার দিন হাজতবাস হয়েছে। ১ নম্বর আসামি কাওছার প্রিন্সিপাল কাজী ফারুকী কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক, সমর্থনে প্রত্যয়নপত্র এবং আইডি কার্ডের ফটোকপি জমা দিয়েছেন। গেট চুরি ছাড়া অন্য কোনো জামিন অযোগ্য ধারার অভিযোগ নেই। ঈদুল আজহার আগের দিন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তা ছাড়া অদ্য হাজতি আসামির জামিন পিটিশন এবং রিমান্ড পিটিশন নিষ্পত্তি করতে অত্র আদালতের আইনগত বাধা আছে মর্মে প্রতীয়মান হয় না।
অতএব ৬ জুন আসামি গ্রেফতার হলেও ফরিয়াদি আইনজীবী হওয়ায় আসামিরা জামিন শুনানির জন্য আইনজীবী না পাওয়ায় এবং লিগ্যাল এইডের অফিস সূত্রে আইনজীবীদের শুনানি করতে অনীহার বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ায় এবং ১৪ জুন পর্যন্ত আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এবং জামিন অযোগ্য ধারার গুরুতর অভিযোগ না থাকায়' আগামী ধার্য তারিখ পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করা হলো।
এদিকে আইনজীবী আবু তৈয়বের করা এই মামলার আসামি প্রভাষক আহমেদ কাওছার বিন জামান এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা আইনজীবী মোরশেদ আলমের ফোন নম্বরে কল দিলে তার স্ত্রী হালিমা মোরশেদ তা রিসিভ করেন। তিনিও 'বাড়তি ক্ষতি যেন না হয়' সতর্কতায় কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানা গেছে, এরই মধ্যে আইনজীবী মোরশেদ আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে আইনজীবী সমিতি। তবে আদালত কক্ষেই অসুস্থ হয়ে লক্ষ্মীপুরের হাসপাতাল হয়ে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বাস্তবতায় তার হাতে এখনো নোটিশ পৌঁছাতে পারেনি সমিতি। আগামী ১৪ জুন আদালতের চলমান ছুটি শেষে হবে। এরপর আদালত খুললে সমিতি এই আইনজীবীর আইন প্র্যাকটিশের অনুমতি বাতিল করার উদ্যোগ এগিয়ে নিচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ নভেম্বর এক আদেশে হাইকোর্ট বলেছেন, কারও পক্ষে যদি কোনো আইনজীবী না পাওয়া যায় তাহলে ভুক্তভোগী বিচারপ্রার্থীর পক্ষে দেশের ৬৪ জেলা জজ কোর্টের সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সমিতির (বারের) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মামলা পরিচালনা করবেন।
বিষয়টি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকে মনিটরিং করতেও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তৎকালীন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান (পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে ওই আদেশ দেন।
কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতিরও সিদ্ধান্ত ছিল, আইনজীবী যদি কোনো মামলার বাদী হন. তাহলে আসামি পক্ষে অন্য কোনো আইনজীবী মামলা পরিচালনার জন্য দাঁড়াতে পারবেন না।
বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আসার পর ওই আদেশ দেন উচ্চ আদালত। উল্লেখ্য, ওই বছর ১০ অক্টোবর কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির ১০ তলা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ওই দিন তিনিও এ বিষয়ে কথা বলেন।
অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ সেদিন তার বক্তব্যে বলেন, আমি শুনেছি, কিশোরগঞ্জ আদালতে বারের কোনো আইনজীবী বা তার আত্মীয়ের নামে মামলা হলে বাদী পক্ষকে কোনো আইনজীবী আদালতে আইনি সহায়তা দেন না। এটা হতে পারে না। এটা অন্যায়। বাংলাদেশের কোথাও এমন কোনো নিয়ম নেই।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মো. রফিক উল্যাহ বলেন, আমরা কোর্ট বর্জনের ডাক দিয়েছি আপাতত। এটি পার্মানেন্ট নয়। আদালত খোলার পর আমরা জরুরি সাধারণ সভা ডেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।
এদিকে গতকাল শনিবার এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জরুরি সাধারণ সভা ডেকেছে লক্ষ্মীপুর আইনজীবী সমিতি। আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় এ সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভার সূচিতে উল্লেখ করা হয়েছে 'অ্যাডভোকেট মো. আবু তৈয়বের করা মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা।