অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
গবেষণার জন্য পরিবেশের উন্নয়ন এবং যোগ্য গবেষক সৃষ্টি না করে, শুধু দেশ-িবিদেশি অর্থায়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে গবেষণার মান বাড়ানো যায় না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন।
বৃহস্পতিবার (১ মে) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডির এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ঋণে বাংলাদেশে গবেষণা প্রজেক্ট হয়। এখন চলছে এইচইএটি প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টের একটা মিটিং হয় হোটেল ইন্টারকনে।
আমি একটি দাওয়াত পাই এবং সেই মিটিংয়ে যাই। আমি আমার বক্তব্যে বলেছিলাম, বাংলাদেশে যেই মানের শিক্ষক, গবেষক ও পরিবেশ; তাতে এই প্রজেক্ট দিয়ে তেমন কোনো লাভ হবে না।
একজন অযোগ্য গবেষককে যতো অর্থই দিন, তাতে কি তার গবেষণা করার ক্ষমতা বেড়ে যাবে?’
ট্যালেন্ট হান্ট প্রজেক্টের পরামর্শ দিয়ে ড. কামরুল হাসান মামুন বলেছেন, ‘গবেষণার জন্য প্রজেক্ট চেয়ে বরাদ্দ দেওয়ার আগে ট্যালেন্ট হান্ট প্রজেক্ট নেওয়া উচিত ছিলো, যার মাধ্যমে সারা বিশ্ব থেকে বিশ্বমানের স্কলার ছেঁকে নিয়ে আসা হবে। এরপর দরকার ছিলো তাদের অধীনে কাজ করার জন্য বিশ্বমানের পোস্ট-ডক ও পিএইচডি শিক্ষার্থী নিয়োগের প্রজেক্ট।
সারা বিশ্বে গবেষণা এখন একটি যৌথ প্রসেস। গবেষক, পোস্ট-ডক, পিএইচডি এবং মাস্টার্স শিক্ষার্থী মিলে তৈরি হয় গবেষণার পরিবেশ; যা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পূর্ণ মিসিং। যাই হোক, অনুষ্ঠানটি হোটেল ইন্টারকনে কেন করতে হলো? কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে করা যেতো না?’
তিনি আরো বলেছেন, ‘বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও পাবেন না, যেখানে পোস্ট-ডক আছে। একটিও নাই। আর মেধাবী পিএইচডি ফেলোও নাই। যারা আসলেই মেধাবী, তারা ইউরোপ আমেরিকা বা জাপান কিংবা কোরিয়ায় চলে যায়। আর গবেষকরা ব্যস্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট-টাইম পড়ানোতে, নাহয় কনসালট্যান্সিতে ব্যস্ত। এই শিক্ষক বা গবেষকদের পেছনে প্রোজেক্টের নামে অর্থ খরচ করে কী লাভ হবে?
এর আগেও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অধীনে এইচইকিউইপি প্রজেক্ট ছিলো, যা ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। বিশাল অঙ্কের টাকা দুই হাতে খরচ হয়েছে। ওই প্রজেক্টের আগে বাংলাদেশের গবেষণার অবস্থা কী ছিলো আর প্রজেক্ট শেষে বাংলাদেশ গবেষণায় কতটা আগালো তার কোনো রিপোর্ট কোথাও পেলাম না।
প্রজেক্ট যেহেতু ছিলো, টাকা যেহেতু ছিটিয়েছিলো, কাজ তো কিছু হয়েছিলো নিশ্চই। কিন্তু প্রশ্ন হলো গবেষণায় কী সাবস্টেনশিয়াল উন্নতি আমাদের হয়েছে?’
এই অধ্যাপক বলেছেন, ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক তো আর বিনা শর্তে ঋণ দেয় না। তাদের শর্ত থাকে। শর্তগুলো এমন যে, গবেষকরা গবেষণা করা ও গবেষণা থেকে প্রাপ্ত রেজাল্ট দিয়ে গবেষণাপত্র লেখার চেয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে কয়েক মাস পর পর প্রজেক্ট স্ট্যাটাস রিপোর্ট লিখতে ব্যস্ত থাকতে হয়। তার ওপর যন্ত্রপাতি কেনার টেন্ডারসহ অন্যান্য আনুসাঙ্গিক আমলাতান্ত্রিকতা তো আছেই।
যেখানে টেন্ডার, ঠিকাদার ইত্যাদি থাকে; সেখানে শিক্ষকদের অর্থলোভী করার পথ খোলার একটা প্রক্রিয়াও খুলে যায়। তার ওপর প্রজেক্ট রিপোর্ট লিখতে গিয়ে কেরানিগিরিও শিখে যায়। আমি এসব প্রজেক্টের ঘোর বিরোধী।’
তিনি আরো বলেন, ‘যেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক থাকে না, টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকে না, পিএইচডি শিক্ষার্থী থাকে না বললেই চলে, সেই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় আছে বলতেও লজ্জা লাগে।
আমেরিকার লিবারেল আর্টস কলেজে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে অনেক ভালো মানের শিক্ষক আছে কিন্তু তাদের কলেজ বলা হয়। কারণ সেখানে গবেষণা সেরকম হয় না।
ওখানে কেবল আন্ডারগ্রাজুয়েট লেখাপড়া। ওদেরকে একটু আধটু গবেষণা শেখাতে যতটুকু গবেষণা লাগে, সেটুকু করে। আমাদের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ওদের লিবারেল আর্টস কলেজ থেকেও খারাপ মানের।
আমাদের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে অথচ একটিও পোস্ট-ডক নাই। আর আমেরিকা বা ইউরোপে একেকটি বিভাগে ৪০ বা তার চেয়েও বেশি পোস্ট-ডক থাকতে পারে।’
তার মতে, ‘শিক্ষকরা কেন টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকবে? প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রপাতি কেনার উইংস থাকবে। ডিমান্ড আসলে তারা দ্রুত কেনার ব্যবস্থা করবে অথবা শিক্ষকদের ফ্রিহ্যান্ড থাকবে, সে তার প্রয়োজনমতো বাজার থেকে সরাসরি কিনে নিবে। সারা পৃথিবীতেই তা হয়।
আমাদের এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রপাতি কেনার উইংস থাকলেও বিশ্বাস করে না। স্বয়ং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও অ্যাপ্রোভ করে না। আবার শিক্ষকদেরকেও বিশ্বাস করে না। আর আমরা যেই মানের শিক্ষক নিয়োগ দেই, তাদের যেই বেতন দেই তাতে সততা চাওয়াও অন্যায়। এই হলো বাংলাদেশের গবেষণার স্বল্প দৈর্ঘ্যের একটা গল্প।’