পাবলিক পরীক্ষায় খয়রাতির নম্বর আর না | মতামত নিউজ

পাবলিক পরীক্ষায় খয়রাতির নম্বর আর না

রাষ্ট্র তাকে কোন খয়রাতি নম্বর দেবেনা। শিক্ষা বিভাগের প্রধানের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য, এ ধরনের দৃঢ়তাই প্রকৃত শিক্ষকরা আশা করেন।

অতি সম্প্রতি শিক্ষা উপদেষ্টা নারায়ণগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘এ প্লাস আর গোল্ডেনে সয়লাব হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করে। শিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে করে শিক্ষার্থীরা যে নম্বর অর্জন করে তারা যা পারেন তার ওপরই যেনো নম্বর হয়’ অর্থাৎ তারা যা পারেন নম্বরও সে রকম হতে হবে।

রাষ্ট্র তাকে কোন খয়রাতি নম্বর দেবেনা। শিক্ষা বিভাগের প্রধানের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য, এ ধরনের দৃঢ়তাই প্রকৃত শিক্ষকরা আশা করেন। শিক্ষার্থীদের অবস্থা আর বোর্ড পরীক্ষায় পাস এবং গ্রেড দেখে প্রকৃত শিক্ষকদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, অথচ তারা কিছু বলতে পারেন না, করতেও পারেন না; শিক্ষার দুর্গতি দেখে বুক চাপড়িয়ে থাকেন।

তারা দেখতে পাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানে এবং জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মূল্যায়ন হচ্ছেনা, তাদের শ্রেণি অনুযায়ী যা যা জানা দরকার তার ধারে কাছেও নেই অথচ বোর্ড পরীক্ষায় সর্বোচ্চ গ্রেডটি পেয়ে বসে থাকেন। সেই কথাটিই শিক্ষা উপদেষ্টা বললেন।

বর্তমান এসএসসি পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন চলছে। কথা হচ্ছে পরীক্ষকদের সঙ্গে প্রধান পরীক্ষকদের সঙ্গেও। যারা এখনও সিনসিয়ার তাদের হা-হুতাশ দেখে একদিকে ভাল লাগে যে, এখনও কিছু শিক্ষক বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন আবার খারাপ লাগে যে এত কিছু পরিবর্তন হলো কিন্তু শিক্ষার্থীদের জানা ও দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হলোনা।

যারা এখনও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, তারা অনুভব করেন, প্রকাশ করেন কিন্তু এটি পাল্টাতে পারেন না। পাল্টানোর জন্য প্রয়োজন যথাযথ কর্তৃপক্ষের বোধেদায়, চিন্তা ও সিদ্ধান্ত। সেই কথাটিই শিক্ষা উপদেষ্টা বললেন।

আমরা আসলেই এতোটি বছর শুধু পাসের বন্যা দেখেছি। এই বন্যাকে প্লাবন বানানোর জন্য রাষ্ট্র থেকে নির্দেশ আসতো কিন্তু শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও জাতির কি হবে সেকথা কেউ চিন্তা করেননি। এভাবে করে করে পাসের হার শতভাগে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, এই ট্রেন্ড চলতে থাকলে শিক্ষার্থীদের আর বই টাচ করার দরকার ছিলো না। কোনো ধরনের লেখার দরকার ছিলো না।

পরীক্ষার্থী নাম নিলেই পাস, পরীক্ষার্থী নাম নিলেই জিপিএ-৫ । এতে যেসব প্রতিষ্ঠান জাতির কাছে, বিবেকের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো, যেসব শিক্ষক বিবেকের কাছে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ তাদের হয়েছিলো মারাত্মক সমস্যা। সেই কথাটিই উপদেষ্টা বুঝতে পেরেছেন। ধন্যবাদ তাকে। তবে তিনি একা কিন্তু এটি করতে পারবেন না। এটি করার জন্য শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সবাইকে কাজ করতে হবে। সস্তায় জনপ্রিয়তা, সস্তায় পাস অনেকেই চান, কিছু না করে বিনিময় অনেকেই চান এবং তাদের সংখ্যাই বেশি। কাজেই এ ধরনের সৎ কথাবার্তা সবার পছন্দ নাও লাগতে পারে।

কিন্তু এটি বাস্তব যে, শিক্ষার্থীরা যে নম্বর পাচ্ছেন বোর্ড পরীক্ষায় তাকে কোনোভাবে শিক্ষার ভিত্তি ধরা যায়না। কোনোভাবে একজন শিক্ষার্থীরা প্রকৃত মেধা যাচাই হয়না, কোনোভাবে বুঝা যায় না যে, একজন শিক্ষার্থী একটি বিষয়ের ওপর মূল ধারণা অর্জন করতে পেরেছেন কিনা। প্রশ্ন যেভাবে করা হচ্ছে তা সে যে নামেই হোক না কেনো ( সৃজনশীল, এমসিকিউ, ছোট প্রশ্ন, বড় প্রশ্ন) শিক্ষার্থীদের পাস করানোই যেনো আসল কথা।

তারপর আবার খাতা পরীক্ষণে থাকে বিভিন্ন ধরনের ছাড়। অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে খাতা দেখতে হবে, শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি নম্বর দিতে হবে, কিছু লিখলেই নম্বর দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে যেটি হয়েছে শিক্ষার্থীরা আর পড়তে চাননা, পড়ার দরকার নেই কারণে যিনি পড়েছেন, পড়াশোনার পেছনের সময় দিয়েছেন তিনিও যে নম্বর পান যিনি পড়েননি, সময় ব্যয় করেননি, বুঝার চেষ্টা করেননি তিনিও একই নম্বর, এমনকি বেশি নম্বর পেয়ে উচ্চগ্রেড পেয়ে থাকেন।

কারণ হচ্ছে একজন শিক্ষার্থী কি পারেন আর কি পারেন না সেটির ওপর মূল্যায়ন হচ্ছেনা, বরং তাকে কিভাবে পাস করিয়ে দেয়া যায়, কিভাবে বেশি নম্বর দেয়া যায সেই কসরত চলে বোর্ড থেকে পরীক্ষক পর্যন্ত। এসএসসি পরীক্ষার একজন প্রধান পরীক্ষক ক’দিন আগে বললেন স্যার, প্রশ্নে নম্বর ৫ অথচ পরীক্ষকরা সেখানে ৭ দিয়ে রেখেছেন। ৫-এর মধ্যে ২ পাবেন কিনা সন্দেহ, সেখানে বুঝে না বুঝে কিংবা অনুমান করে ৭ দিয়ে রেখেছেন। ঐ পরীক্ষকও জানেন যে, নম্বর বেশি দিলে কোনো সমস্যা নেই, কম দিলেই বরং সমস্যা। এ ধরনের প্রধান পরীক্ষক তো এ যুগে কম যিনি এত খুঁটে খুঁটে খাতা চেক করবেন এবং এ ধরনের ত্রুটি বের করবেন। এসব ক্ষেত্রে একমাত্র দুর্বল ও অমনোযোগী শিক্ষার্থীরা বেশ লাভবান হয়ে থাকেন।

শিক্ষা উপদেষ্টা আরো একটি কথা বলেছেন, স্কুলগুলোকে এমনভাবে গড়ে তুলতে চাই যেনো শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে আগ্রহী হন। স্কুলগুলোকে এভাবে ভালো স্কুলে পরিবর্তন করার কথা বলেছেন। বর্তমানে ভালো স্কুল বলে আমরা যেগুলোকে ধরে নিই, সেগুলোতে ভর্তি হতে না পারলে অনেক অভিভাবক হতাশ হন, সেটি না হওয়ার জন্যও তিনি অনুরোধ করেছেন। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ‘খয়রাতি নম্বর’ অর্থাৎ সহানুভূতির সঙ্গে খাতা মূল্যায়নের কথা বলেন যেটি অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। বোর্ড থেকে সহানুভূতির সঙ্গে খাতা দেখতে বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা বিষয়ের ধারণা জানেন না, বুঝানোর ভাষাও ব্যবহার করতে পারেননি অথচ পৃষ্ঠা ভর্তি করলে, খাতা ভর্তি করলে, এমনকি পরীক্ষার খাতার অধিকাংশই খালি রাখলেও ভাল পাস নম্বর আসে, ভাল গ্রেড আসে।

এই আসার অর্থ হলো মূল্যায়ন অর্থহীন। মূল্যায়নের চেয়ে দয়া বা খয়রাত করে নম্বর পাওয়াটাই যেনো বেশি মূল্যবান। এই অবস্থাই চলে এসেছে বহু বছর যাবৎ, এ নিয়ে আমারা যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করি, চিন্তা করি তারা বারবারই বিভিন্নভাবে বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু কেউ তা কানে তুলছেন না। এবার স্বয়ং শিক্ষা উপদেষ্টা বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। ধন্যবাদ শিক্ষা উপদেষ্টা।

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক