জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজন বড় সংস্কার | মতামত নিউজ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজন বড় সংস্কার

যদিও এখানে দেশের উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশই এখানে পড়াশোনা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় প্রতিবছর দশ লাখ শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েট হচ্ছেন।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২১ অক্টোবর ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর চাপ কমাতে ও শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (এনইউ) প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীর দিক থেকে এটি দেশের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। মানের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিচে।

যদিও এখানে দেশের উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশই এখানে পড়াশোনা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় প্রতিবছর দশ লাখ শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েট হচ্ছেন। তার অর্থ হচ্ছে এই বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েট করতে শিক্ষকরা পরিশ্রম করছেন, দেশের অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। কিন্তু এর মান নিয়ে বিরাট প্রশ্ন। এখানে বৃহৎ সংস্কারের প্রয়োজন।

দেশের শিক্ষাবিষয়ক একমাত্র ডিজিটাল পত্রিকা ‘দৈনিক শিক্ষাডটকম’ এবং প্রিন্ট জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’ প্রকাশ করেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর আবেদন করেছেন প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী। গতকাল শনিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তাদের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

সারাদেশের জেলা শহরের ১৩৭টি কেন্দ্রে একযোগে এ পরীক্ষা নেয়া হয়। বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে আগেই প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী। ঢাকা বিভাগে সর্বাধিক ২৪৭টি কেন্দ্র রয়েছে। এরপর খুলনা বিভাগে ১৫৬টি, রাজশাহী বিভাগে ১৪৩টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩৪টি, রংপুর বিভাগে ৯৬টি, বরিশাল বিভাগে ৫৯টি এবং সিলেট বিভাগে ৪৪টি কেন্দ্রে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। দেশের সাতটি বিভাগের ৮৭৯টি কেন্দ্রে একযোগে এই ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এসব কেন্দ্রের মধ্যে সরকারি কলেজ ছাড়াও স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও পরীক্ষাকেন্দ্র হেসেবে ব্যবহার করা হয়। ভর্তি পরীক্ষাও এই সংস্কারের একটি বড় অংশ।

ভর্তি পরীক্ষাটি ৩ মে নির্ধারিত থাকলেও তা পিছিয়ে ২৪ মে এবং পরে আরো এক সপ্তাহ পিছিয়ে ৩১ মে পুননির্ধারণ করা হয়। ভর্তি পরীক্ষা ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। এর আগে কেন্দ্রগুলোর অধ্যক্ষ ও কেন্দ্র সচিবদের নিয়ে মিটিংও করা হয়। পরীক্ষা পদ্ধতি অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের এমসিকিউ ভিত্তিক ১০০ নম্বরের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, যা এক ঘণ্টায় সম্পন্ন করা হয়।

মেধাতালিকা প্রস্তুতে ভর্তি পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষার জিপিএর ৪০ শতাংশ এবং এইচএসসি পরীক্ষার জিপিএর ৬০ শতাংশ যুক্ত করে মোট ২০০ নম্বরের ভিত্তিতে ফলাফল নির্ধারণ করা হবে। ভর্তিচ্ছুদের অবশ্যই পরীক্ষার প্রবেশপত্র ও এইচএসসি রেজিস্ট্রেশন কার্ড সঙ্গে আনতে হবে। পরীক্ষায় সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর ব্যবহার করা গেলেও মোবাইল ফোন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস সম্পূর্নরূপে নিষিদ্ধ। প্রায় দশ বছর পরে চালু হওয়া ভর্তি পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়টির মানোন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে। এতে এখানে ভর্তির গুরুত্বটা বেড়ে যাবে এবং শিক্ষার্থীরাও পূর্বের চেয়ে অনেকটাই সচেতন হবেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম আমানুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থা সম্পকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাবলিক প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষার্থী, প্রায় আড়াই হাজারের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উচ্চশিক্ষার ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। গত ১৫ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্পূর্নরূপে ধ্বংস করা হয়েছে।

সেই ধ্বংস্তুপ থেকে দাঁড়িয়ে আজকের আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের শিক্ষকরা পরিশ্রম করেন কিন্তু কোনো দাম নেই।’ আমাদের মনে আচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছরের ৩০ অক্টোবর আলোচনা সভায় ভিসি বলেছিলেন, ‘দেশের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।

তাদের কারিকুলামে কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা নেই। বিদ্যমান কারিকুলাম পরিবর্তন করে বিভিন্ন আইসিটি ও সফট স্কিল অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য আন্তর্জতিক মানের ডাটা সেন্টার, সাইবার সেন্টার করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।

এটি বাস্তবায়ন হলে বিভিন্ন সংস্থা এই বিশ্ববিদ্যালয়টির কাছে আসবে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়টির সম্মান বাড়বে। প্রথমবারের মতো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় আড়াই হাজার কলেজে গভর্নিং বডি তৈরি করা হয়েছে। কোথাও কোথাও হয়তো কোনো ভুলভ্রান্তি হয়েছে, তবে ধীরে ধীরে সেগুলোর সংশোধনের চেষ্টাও চলছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মানোন্নয়নের জন্য বর্তমান ভিসি এভাবে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেজন্য তাকে অনেক চাপ ও থ্রেটের সম্মুখীনও হতে হচ্ছে। তবে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যেটি সব ভিসিদেরই থাকা উচিত। সম্প্রতি আমরা পত্রিকায় দেখলাম যে, ২০২২ ব্যাচের স্নাতক পরীক্ষার্থীরা আটেপাসের দাবিতে উপাচার্যকে ঘিরে ধরেন। তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কিছু ছাত্র নামধারী দুস্কৃতকারী অসৎ উদ্দেশে উপাচার্যের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেন।

এতে তিনি কিছুটা আহত হন। কিন্তু ভিসি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো ব্যাচের শিক্ষার্থীদের কোনো প্রকার অটোপাস জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অটোপাস দিলে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে।’ আমরাও তাই মনে করি, শিক্ষার্থীদের চাপে পড়ে অনৈতিক দাবি-দাওয়া এবং পড়াশোনা না করে পাস করানোর জন্য হুমকির কাছে মাথা নত করা যাবে না যে উদাহরণ ইতোমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সৃষ্টি করেছেন। আমরা তাকে এজন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

এই যুগের শিক্ষার্থীদের ভাষা, আইসিটি, সফট স্কিল এবং উদ্যোক্তা তৈরি, ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল জানা প্রয়োজন। কিন্তু দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের এগুলো শেখানোর তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তো দূরের কথা। তবে, দেশের প্রথম সারির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদিক থেকে এগিয়ে আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে এসব বিষয়েও সক্রিয়ভাবে ভাবতে হবে।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো সব বর্ষের পরীক্ষা নিচ্ছে। ফলে ব্যাচমেটরা শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে সব পরীক্ষা শেষ করে সময়মতো ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অসহায়ের মতো পরীক্ষার আশায় দিনাতিপাত করছেন। এখানকার শিক্ষার্থীরা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অনেকে ‘মালটানা রেলগাড়ির’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভর্তি পরীক্ষা চালুর মাধ্যমে এই দুর্নাম ঘোচানোর প্রথম পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি।

কলুষিত রাজনীতি, একনায়কতন্ত্র, লাঠিতন্ত্র ও তেলতন্ত্র পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে এলোমেলো করে দিয়েছে, ধ্বংসর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার সংষ্কার প্রযোজন, যেটি একটি বড় পদক্ষেপ। যিনি যেখানে শিক্ষার দায়িত্বে আছেন, তাকে সেখান থেকেই এই সংস্কারে হাত দেয়া উচিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সেই কাজে হাত দিয়েছেন। সমস্যা আসছে এবং আসবে, তারপরেও তিনি সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সেটিকে আমরা সাধুবাদ জানাই। একই সঙ্গে সব মহলের সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার অনুরোধ করছি।

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক