উপলব্ধির নিরিখে | মতামত নিউজ

উপলব্ধির নিরিখে

এই পদ্ধতিতে ভোট গণনার প্রথম ধাপ হলো প্রতিটি প্রার্থীর প্রথম পছন্দের ভোটের মোট সংখ্যা নির্ধারণ করা।

প্রযুক্তি হলো আমাদের জীবনের বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ। প্রযুক্তি মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে বিভিন্ন পণ্য, যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছে। আমাদের ধারণা বা জ্ঞান সৃষ্টি করেছে। এই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বিভিন্নভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের নানান ক্ষেত্র রয়েছে। সম্প্রতি প্রযুক্তি নির্ভর নতুন একটি নাম আলোচনায় এসেছে। সেটি হচ্ছে: ‘পিআর’।

প্রপোরশনাল রেজিস্ট্রেশন ভোটিং (পিআর) এমন একটি নির্বাচনী পদ্ধতি যেটির মূল ধারণা হলো, নির্বাচনে প্রতিটি দলের ভোট প্রাপ্তির হার অনুযায়ী সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। এর ফলে, ভোটারদের ভোটাধিকার আরো বেশি অর্থবহ হয় এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যায়।

পিআর পদ্ধতিটি সম্পর্কে জানা গেছে, এটি মূলত এসেছে সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট (এসটিভি) এবং র‌্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং (আরসিভি)-এই দুইটি পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে, ব্রিটেনে থমাস হেয়ার এবং ডেনমার্কে কার্ল আন্দ্রু স্বাধীনভাবে এই ব্যবস্থার মূল নীতিগুলো আবিষ্কার করেছিলেন। এসটিভি বহু-সদস্যের জেলা বা প্রদেশে এই ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আয়ারল্যান্ড এবং ১৯৯০ খ্রিষ্টব্দে এস্তোনিয়াতে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি অস্ট্রেলিয়ায় তাসমানিয়ান হাউস অব অ্যাসেম্বলি, অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরি লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি ও ফেডারেল সিনেটের নির্বাচনের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের স্থানীয় নির্বাচনেও ব্যবহৃত হয়।

এই পদ্ধতিতে ভোট গণনার প্রথম ধাপ হলো প্রতিটি প্রার্থীর প্রথম পছন্দের ভোটের মোট সংখ্যা নির্ধারণ করা। যে প্রার্থীর প্রথম পছন্দের ভোটের সংখ্যা কোটার চেয়ে বেশি, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাচিত হন। যদি কেউ কোটা অর্জন না করে, তাহলে সর্বনিম্ন প্রথম পছন্দের ভোটের সংখ্যা বাদ দেয়া হয়, এবং তার দ্বিতীয় পছন্দের ভোটটি প্রতিযোগিতায় থাকা প্রার্থীদের মধ্যে পুনরায় বিতরণ করা হয়।

একই সময়ে, নির্বাচিত প্রার্থীদের উদ্বৃত্ত ভোট (অর্থাৎ, কোটার চেয়ে বেশি ভোট) ব্যালট পেপারে দ্বিতীয় পছন্দ অনুসারে পুনরায় বিতরণ করা হয়। ন্যায্যতার জন্য, সমস্ত প্রার্থীর ব্যালট পেপার পুনর্বণ্টন করা হয়, তবে প্রতিটি ভোটের একটি ভোটের ভগ্নাংশ শতাংশে, যাতে মোট পুনর্বণ্টন করা ভোট প্রার্থীর উদ্বৃত্তের সমান হয় (উদাহরণস্বরূপ, আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রে, যেখানে একটি ওজনযুক্ত নমুনা ব্যবহার করা হয়)।

যদি কোনো প্রার্থীর ১০০টি ভোট থাকে এবং তাদের উদ্বৃত্ত দশটি ভোট হয়, তাহলে প্রতিটি ব্যালট পেপার ভোটের ১/১০ ভাগের মূল্যে পুনর্বণ্টন করা হবে। এই প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে যতক্ষণ না নির্বাচনী এলাকার সমস্ত আসন পূরণ হয়।

এসটিভির পরবর্তী ধাপ হলো, র‌্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং (আরসিভি)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরসিভি ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এখন ৫১টি বিচারব্যবস্থায় জনসাধারণের নির্বাচনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

আরসিভি পদ্ধতি নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি মূলত বহুত্ব ভোটদানের ক্ষেত্রে ব্যবহার্য। তুলনামূলক একটি উন্নতি, যার প্রতিনিধিত্ব, প্রচারণার মান, সংহতি এবং ভোটদানের ক্ষেত্রে স্পষ্ট সুবিধা রয়েছে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, আরসিভি বৃহত্তর ঐকমত্য তৈরির পাশাপাশি আরো নাগরিক রাজনৈতিক প্রচারণাকে উৎসাহিত করে। বর্তমানে গবেষণাটির অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন পদের জন্য প্রার্থীদের বৈচিত্র্য, প্রান্তিক বা পরীক্ষা করা কঠিন প্রভাব রয়েছে।

গবেষক ড্রুটম্যান এবং স্ট্রানো ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘আরসিভি এক ধরনের সুবিধা যেখানে একজন ভোটারের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। তবে আমরা মনে করি এখানে কিছু প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনলে, এটি আরো গ্রহণযোগ্য হবে।’

এসটিভি এবং আরসিভির সম্মিলিত রূপ পিআর। এটি হলো বহুত্ব-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটদানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। উন্নত পশ্চিমা গণতন্ত্রের মধ্যে এটি প্রধান ভোটদান ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম ইউরোপে, ২৮টি দেশের মধ্যে ২১টি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবহার করে, যার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, সাইপ্রাস, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পর্তুগাল, স্পেন, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড।

পিআর নির্বাচনী ব্যবস্থার ডিজাইনাররা আনুপাতিক ফলাফল অর্জনের জন্য এই উপায়টি তৈরি করেছেন। এটি তিনটি মৌলিক ধরনের জনসংযোগের যৌথ যৌগ। এই যৌগগুলো হচ্ছে, ১. দলীয় তালিকা। ২. মিশ্র-সদস্য। ৩. একক-স্থানান্তরযোগ্য ভোট (যাকে পছন্দের ভোটও বলা হয়)।

১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের প্রাচীনতম নির্বাচনী সংস্কার ও প্রচার সংস্থা ইলেক্টোরাল রিফর্ম সোসাইটি (ইআরএস)-এর তথ্য মতে নির্বাচনের ক্ষেত্রে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হলো এমন একটি ধারণা যে, সংসদে আসন সংখ্যা প্রদত্ত ভোটের অনুপাতে হওয়া উচিত।

অপরদিকে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে সংসদে কে বসবে তা নির্ধারণের অনেকগুলো ভিন্ন উপায়। আরো আনুপাতিক পদ্ধতির অর্থ হলো যে একটি দল যে এক-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়েছে তারা সংসদে এক-তৃতীয়াংশ আসন আশা করতে পারে। এমন ব্যবস্থায় সর্বাগ্রে যে পদ্ধতির নাম আসে, সেটি হচ্ছে ‘পিআর’ পদ্ধতি।

নির্বাচন ক্ষেত্র, ভোট প্রদান, প্রভৃতি নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করছে ওয়ার্ন্ড এসোশিয়েশন ফর পাবলিক ওপেনিয়র রিসার্স (ডাব্লিউপিওআর)। পিআর নিয়ে এখন পর্যন্ত তাদের গবেষণায় যেসব তথ্য এসেছে, তা পর্যাপ্ত নয় বলে মতামত দিয়েছেন ডাব্লিউপিওআর। তারা বলছেন, এটা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ব্যবস্থা। এটিকে ঘিরে নানান ধরণের তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সমর্থকরা যুক্তি দেন যে একটি নির্বাচন হলো দেশ কীভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত সে সম্পর্কে মতামতের একটি আদমশুমারির মতো, এবং শুধুমাত্র যদি একটি সংসদ একটি দেশের মধ্যে সম্পূর্ণ বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব করে তবেই তার সিদ্ধান্তগুলোকে বৈধ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, সমর্থকরা মনে করেন যে বহুত্ব ব্যবস্থা অপ্রতিনিধিত্বমূলক, সংখ্যালঘু সরকার তৈরি করতে পারে, যেমন যুক্তরাজ্যে। সেখানের দুটি প্রধান দল বিংশ শতাব্দীর শেষ তিন দশক ধরে ৪০ শতাংশেরও বেশি ভোট নিয়ে দেশ শাসন করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বা বহুত্ব ব্যবস্থার অধীনে উদ্ভূত সম্ভাব্য অসঙ্গতি প্রতিকারের উপায় হিসাবেও আনুপাতিক ব্যবস্থার পরামর্শ দেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, একটি দল তার বিরোধীদের তুলনায় কম জনপ্রিয় ভোট নিয়ে বেশি আসন জিততে পারে, যেমনটি ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে এবং ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ নির্বাচনে ঘটেছিলো।

দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেট্রোরাল সিস্টেম (আইএফইএস)-এর এক জার্নালে পিআর সম্পর্কে লেখা হয়েছে, এটি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনী ব্যবস্থা যা একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা তৈরি করতে চায়। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য জনসমর্থনের সামগ্রিক বণ্টন প্রতিফলিত করে। এটি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোকে তাদের নির্বাচনী সমর্থনের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের একটি পরিমাপ নিশ্চিত করে। বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, গ্রিস, হাঙ্গেরি, ইসরায়েল, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে, রাশিয়া, স্পেন, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ডসহ অনেক দেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।

সার্বিক বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পিআর পদ্ধতিতে ভোট দেয়া-নেয়ার বিষয়টি খুব সহজ নয়। যদি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রে এটি সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে সুষ্ঠু ধারণা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় হাতে নেই।

বাংলাদেশে বহু বছর ধরে নির্বাচন কেন্দ্রীক ঘটনা বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় যুক্ত করা হয়েছিলো ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। ইভিএম পদ্ধতির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এগুলো থেকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ধারণা হয়েছে ভোট দেয়া বা না দেয়া একই ব্যাপার। অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কি তেমনই কিছু ঘটবে? অতীতের ধারাবাহিতায় বিষয়টি কী ‘ঝোলের লাউ অম্বলের কদু’-ই প্রচলিত থাকবে?

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ অক্টোবর ‘আলোচনায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা’- শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনের আলোকে জানা গেছে, বিএনপি ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল গুলোর ‘পিআর’ পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে আপত্তি নেই।

২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই বিএনপি আয়োজিত ‘গণঅভ‍্যুত্থান ২০২৪: জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (পিআর) ব্যবস্থার উপযোগিতা নিয়ে ভেবে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন।

অপরদিকে, একই দিনে সিলেটে এক অনুষ্ঠানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম (পীর সাহেব চরমোনাই) বলেছেন, ‘দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনই সর্বোত্তম। পিআর পদ্ধতিতে দলগুলো প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদীয় আসন পায়।’

প্রথম থেকেই বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিপক্ষে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং তুলনামূলক শক্তিশালী দল যে ব্যবস্থায় নির্বাচন চাইছে না, সেই ব্যবস্থাতেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা আদৌ শুভ লক্ষণ নয়।

অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশের সাধারণ মানুষের বিরাট আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এই আকাঙ্ক্ষা যদি নষ্ট হয়, সেটা হবে অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখের। আমাদের আশা ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন হবে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সফল। আমাদের আশা বিচ্যুত হবে না, সেটা মনে করেই আশা রাখি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক