সংসদীয় পদ্ধতিতে আমৃত্যু ক্ষমতা দখলে রাখার সুযোগ আছে বলে মন্তব্য করে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকাতে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন।
শনিবার (১২ এপ্রিল) রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া কনভেশন সেন্টারে এক সেমিনারে তিনি বলেন, সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের পরিবর্তে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ চেপে বসেছে। তিনি জনগণ এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জনগণ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য জরুরি। বাংলাদেশে নীতিহীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং উচ্চাভিলাসী সেনা কর্মকর্তারা তাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে সামরিক বাহিনীতে রাজনীতিকরণ করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে সামরিক বাহিনীর রাজনীতিকরণ শুরু বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, সংসদীয় পদ্ধতিতে আমৃত্যু ক্ষমতা দখলে রাখার সুযোগ আছে। সেই সুযোগ নিয়েই শেখ হাসিনা পুলিশ, র্যাব ও ডিজিএফআইকে ব্যবহার করে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্নমত দমন করেছেন; জনগণের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন; দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়েছেন এবং ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের আদলে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি প্রবর্তনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনার সময় এসেছে। আমার প্রস্তাব হলো, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সর্বোচ্চ দুবার পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য একজন নাগরিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারবেন। এই দুই মেয়াদ উপর্যুপরি হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
তিনি বলেন, আমি যে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির কথা প্রস্তাব করছি সেখানে নির্বাচিত সংসদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার যথেষ্ট ভারসাম্য থাকতে হবে। আমার প্রস্তাবিত প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান কিংবা এরশাদের মতো একক ক্ষমতাশালী হবেন না। প্রেসিডেন্ট এবং সংসদের মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্যের রূপরেখা প্রস্তাব করার জন্য আমাদের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে একাধিক প্রস্তাব, সেমিনারে বিতর্ক এবং রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে। আমি মনে করি, প্রেসিডেন্টের দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতাসীন থাকার সুযোগ যদি সংবিধানে রহিত করা থাকে এবং প্রেসিডেন্ট ও সংসদের মধ্যে যদি ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা যায় তাহলেই ফ্যাসিবাদের উত্থানের সুযোগ আমরা বন্ধ করতে সক্ষম হব।
আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক বলেন, সংসদ নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি সংবিধানে পুনঃসংযোজন করতে হবে। আমরা দেখেছি যে, সর্বশেষ প্রধান বিচারপতিকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান করার পদ্ধতি রাজনীতিবিদদের অসততা ও অসহযোগিতার কারণে কেবল ব্যর্থই হয়নি, সেই সঙ্গে বিচার বিভাগও কলুষিত হয়েছে। সুতরাং আমাদের নতুন কোনো পদ্ধতির কথা চিন্তা করতে হবে। আমি রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা শুরুর জন্য কেয়ারটেকার সরকারের একটি প্রাথমিক প্রস্তাব উত্থাপন করছি। আমার প্রস্তাব অনুযায়ী ৯০ দিনের মেয়াদের নির্বাচনকালীন সরকারে ১১ জন সদস্য থাকবেন। নির্বাচিত সংসদের সরকারি ও বিরোধী দল ৫ জন করে এবং প্রধান বিচারপতি একজন সদস্যের নাম প্রেসিডেন্টের কাছে প্রস্তাব করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের এই ১১ জন সদস্য গোপন ব্যালটের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করবেন।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সমন্বয় করার উদ্দেশে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ সৃষ্টির জন্য আমি প্রস্তাব করছি। এই পদে যিনি আসবেন তার আধুনিক ও সার্বিক রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সম্পর্কে জ্ঞান থাকার পাশাপাশি বিশ্ব ভূরাজনীতি বিষয়েও ব্যুৎপত্তি থাকতে হবে। ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজারের পদ রয়েছে। এই পদে সামরিক কিংবা বেসামরিক ব্যক্তি বিবেচিত হতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, যে সব সেনা অফিসার শেখ হাসিনার আমলে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের দায়ে, বিশেষ করে আয়নাঘর সৃষ্টি এবং মহান জুলাই বিপ্লবে গণহত্যায় সম্পৃক্ত থেকেছেন তাদের অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন করতে হবে।
মাহমুদুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই অনভিপ্রেত বিতর্ককে কেন্দ্র করে পতিত ফ্যাসিবাদ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদ মিলিতভাবে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বাড়িয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে। আমার বিশ্বাস, সেনাবাহিনীর কিছু সুযোগসন্ধানী কর্মকর্তার মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলেও সেনাবাহিনীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আন্তরিকভাবে ড. ইউনূস সরকারের সাফল্য দেখতে চান। বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের ভারতীয় আধিপত্যবাদী আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিত। আমরা এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না, যাতে করে জনগণ এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে কোনোর রকম দূরত্ব অথবা ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ সৃষ্টি হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় ভারত থেকে সামরিক অভ্যুত্থানের দৃশ্যমান উসকানি থাকলেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে কোনো দেশ সেই হঠকারিতা সমর্থন করবে না। বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান হলে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা এবং শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে হবে।
মাহমুদুর রহমান বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন আমলে সামরিক বাহিনীতে যে রাজনীতিকরণ হয়েছে তার জন্য কোনো এক পক্ষ দায়ী নয়। কখনও ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসাররা ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছেন; কখনও রাজনীতিবিদরাও নিজেদের অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেছেন। দেশের জন্য এই ক্ষতিকর অশুভ পরিস্থিতির অবসান হওয়া জরুরি।