শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে প্রাথমিকে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ, অভিভাবকদের উদ্বেগ | স্কুল নিউজ

শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে প্রাথমিকে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ, অভিভাবকদের উদ্বেগ

চাকরির শুরুতে ১১তম বেতন গ্রেড নির্ধারণসহ তিন দফা দাবিতে সোমবার থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি শুরু করেছেন দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা।

#স্কুল #শিক্ষক #শিক্ষার্থী

চাকরির শুরুতে ১১তম বেতন গ্রেড নির্ধারণসহ তিন দফা দাবিতে সোমবার থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি শুরু করেছেন দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা। এর ফলে দেশের ৬৫ হাজার ৫৬৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম (ক্লাস-পরীক্ষা) বন্ধ হয়ে গেছে। এই আন্দোলনের কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছেন এক কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী।

শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত চালু করার দাবি জানিয়ে অভিভাবকরা বলেছেন, এবার প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা কিছুটা দেরিতে পাঠ্যবই পেয়েছে। পুরোদমে ক্লাস শুরু করতেও এক-দেড় মাস দেরি হয়েছে। তার ওপর শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে শিখন ঘাটতি আরও বাড়ছে।

সূত্র মতে, দেশের ৬৫ হাজার ৫৬৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষকসংখ্যা ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৫১৩ জন। এদের মধ্যে প্রধান শিক্ষক ৩৫ হাজারের কিছু বেশি। সহকারী শিক্ষক প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিসংখ্যান ২০২৩ এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৫। তাদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ১ কোটি ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৮১৫ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৫৫.৭৩ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী আগামী ৩ জুন ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হবে। এর আগ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছয় কার্যদিবস শিক্ষা কার্যক্রম চলমান থাকার কথা। তবে শিক্ষকদের আন্দোলনের জেরে এ সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হলো।

বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের সভাপতি মো. আনিসুর রহমান বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামানের সঙ্গে শিক্ষক প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়েছে। মহাপরিচালক আমাদের পদোন্নতি ও উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতা নিরসনের আশ্বাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে একাদশ গ্রেডে বেতনের প্রস্তাব পাঠানোর কথাও বলেছেন। তবে আমরা আশ্বাসে বিশ্বাসী নই।

আন্দোলনকারী সহকারী শিক্ষকদের তিন দফা দাবি হলো- প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে করা পরামর্শক কমিটির সুপারিশের যৌক্তিক সংস্কার করে সহকারী শিক্ষক পদকে শুরুর পদ ধরে ১১তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতা নিরসন এবং প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগসহ দ্রুত পদোন্নতি।

দাবি আদায়ে গত ৫ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত দিনে এক ঘণ্টা, ১৬ মে থেকে ২০ মে পর্যন্ত দিনে দুই ঘণ্টা, ২১ মে থেকে ২৫ মে পর্যন্ত অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকরা। কিন্তু তিন দফা দাবি বাস্তবায়নে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখতে না পেয়ে গতকাল থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে গেছেন তারা।

সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন বলেন, শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের কোনো ইচ্ছে আমাদের নেই। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি শিক্ষার্থীদের শিখন কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে দাবি আদায়ের। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের দাবির বিষয়ে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো আলোচনারও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা বাধ্য হয়েই এমন কর্মসূচিতে গেছি।

অভিভাবকরা জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি বিদ্যালয়ের তুলনায় ছুটি বেশি। এ কারণে এরই মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে আছে। সামনে ঈদুল আজহার ছুটি রয়েছে। এর আগে শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে ক্লাস বন্ধ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে আমরা চিন্তিত।

বর্তমানে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। এ গ্রেড অনুযায়ী তাদের মূল বেতন ১১ হাজার টাকা। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ পান সাড়ে ১৯ হাজার টাকার মতো। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতনই সর্বনিম্ন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতন পান দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের শিক্ষকরা। দেশটির প্রাথমিকের শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতন প্রায় ৯৫৩ ডলার ১৩ সেন্ট, যা বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ গুণ। এমনকি পাকিস্তানেও শিক্ষকদের গড় বেতন ২০৬ ডলার ৭ সেন্ট ও শ্রীলঙ্কায় ২৫০ ডলার ৪৪ সেন্ট। ভারতে রাজ্য বিষয়ভেদে শিক্ষকদের বেতনের ভিন্নতা রয়েছে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেতন কাঠামো নিয়ে তথ্য সংরক্ষণকারী সংস্থাগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভারতের শিক্ষকদের গড় মাসিক বেতন ২৮৪ ডলার ৬৪ সেন্ট। এছাড়া ভুটানে প্রাথমিকের শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতন ৩৪১ ডলার ৭২ সেন্ট এবং নেপালে ৪৬৭ ডলার ৪৫ সেন্ট। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারেও শিক্ষকদের গড় বেতন ১৮৯ ডলার ২২ সেন্ট।

শিক্ষকদের দাবিকে যৌক্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করে শিক্ষাবিদরা বলেন, প্রাথমিকেই শিশুর শিক্ষার ভিত তৈরি হয়। কিন্তু যারা সেই ভিত রচনা করেন, সেই শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী! শিক্ষক নেতারা বলেন, প্রাথমিকের শিক্ষকদের গড় বেতন ১৭০ ডলার ২ সেন্ট, যা দেশের মাথাপিছু গড় মাসিক আয়ের তুলনায় প্রায় ৬২ ডলার কম। উচ্চমূল্যে খাবার কিনে খেয়ে প্রাথমিকের একজন শিক্ষকের পক্ষে সংসার চালানো পাহাড়সম কঠিন হয়ে পড়েছে।

#স্কুল #শিক্ষক #শিক্ষার্থী