গত ২৫ মে দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ প্রকাশিত “বিতর্কিত তিন প্রতিষ্ঠানই পাচ্ছে দেড়শ কোটি টাকার পাঠ্যবই ছাপার কাজ!’ শিরোনামের প্রতিবেদনের কিছু অংশের প্রতিবাদ জানিয়েছে প্রিন্ট মাস্টার প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং লিমিটেড এবং মাস্টার সিমেক্স পেপার লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান । গত ২৯ মে দৈনিক শিক্ষাডটকম এর অফিসে পাঠানো প্রতিবাদলিপিতে তারা নিজস্ব ব্যাখ্যায় দাবি করেছে, প্রকাশিত প্রতিবেদনের কোনো তথ্যই সত্য নয়। প্রতিবাদলিপিতে যথাক্রমে প্রিন্ট মাস্টারের উপমহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) তোফায়েল আহমেদ খান ও মাস্টার সিমেস্ক-এর পরিচালক (প্রশাসন) শেখ ইমরান হোসেন স্বাক্ষর করেছেন।
আরও পড়ুন: রাতের অভিযানে মাস্টার সিমেক্সের গোডাউন থেকে পাঠ্যবইয়ের বিপুল কাগজ জব্দ
প্রতিবেদকের বক্তব্য : প্রতিবাদলিপি দুটো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দৈনিক শিক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই এমনসব প্রসঙ্গও বলা হয়েছে। দৈনিক শিক্ষা কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য কখনো কোনো প্রতিবেদন বা ভুল তথ্য প্রচার ও প্রকাশ করে না। রিপোর্টের উপাদান থাকলেই কেবল সেই বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। সেটা কার পক্ষে বা বিপক্ষে যায় সেটা বিবেচনা করে না।
দৈনিক শিক্ষায় তিন প্রতিষ্ঠান ও টেন্ডারে ছাপা মেশিনের নতুন সাইজ সম্পর্কিত বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। ইতিমধ্যে ওই টেন্ডারের সংশোধনী দিয়েছে। যাতে শুধু ওই তিন প্রতিষ্রঠান নয় সবাই অংশ নিতে পারেন। এনসিটিবির একাধিক সূত্র দৈনিক শিক্ষাডটকমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। সরকারের এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আরেকবার প্রমাণিত দৈনিক শিক্ষার প্রতিবেদনের তথ্যের সত্যতা।
প্রকৃতপক্ষে মাস্টার সিমেক্স ও প্রিন্ট মাস্টার সম্পর্কে গত কয়েকমাসে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ও এবং একাধিক সংস্থার প্রতিবেদন এবং প্রাক-প্রাথমিকের টেন্ডার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্যই লেখা হয়েছে। প্রাক প্রাথমিকের টেন্ডার সিন্ডিকেট সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থাও প্রতিবেদন দিয়েছে সরকারের কাছে। এছাড়া শিক্ষা প্রশাসনের উর্দ্ধতন মহলে যোগাযোগ করে জানা গেছে, প্রাক-প্রাথমিকের ওই টেন্ডারের শর্ত সংশোধন করা হয়।
প্রাক প্রাথমিকের সেই টেন্ডার সম্পর্কে সরকারের কাছে জমা দেওয়া একটি সংস্থার প্রতিবেদনে টেন্ডারের বিষয়ে প্রিন্ট মাস্টার ও মাস্টার সিমেক্স সম্পর্কে বলা হয়েছে :
“এনসিটিবি বর্ণিত তিনটি প্রতিষ্ঠানের সাথে আঁতাত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে বর্ণিত শর্ত আরোপ করেন। বিতর্ক এড়াতে যে সব প্রেসের শিট মেশিন রয়েছে তাদের টেন্ডারে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু শিট মেশিনে অত্যন্ত ধীরগতিতে মুদ্রণ হওয়ায় এনসিটিবি কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মুদ্রণ সম্পন্ন করতে পারে না বিধায় শিট মেশিনের মালিকগণ টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবেন না বলে জানা যায়। তবে প্রতিযোগিতা দেখানোর জন্য উক্ত ৩টি প্রেস সংশ্লিষ্ট শিট মেশিনের প্রেস মালিকগণ টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করলেও মুদ্রণ কাজ মূলত তারাই (৩টি প্রেস) করবে। উক্ত সিন্ডিকেটের তিনটি প্রতিষ্ঠান ব্যতিত অন্য সকল প্রতিষ্ঠান প্রাক-প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না।”
সংস্থাটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, “মাস্টার সিমেক্স প্রিন্টিং প্রেস (মালিক দেওয়ান কবীর ডিবির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদের ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে পরিচিত), বারতোপা প্রিন্টিং প্রেস ও প্রিন্ট মাস্টার প্রিন্টিং প্রেস (মালিক যথাক্রমে অনুপ কুমার দে ও শহিদুল ইসলাম উভয়ই সাবেক চিপ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরী লিটনের (লিটন চৌধুরী) ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে পরিচিত। এর সাথে যোগসাজশে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক রিয়াদ চৌধুরী কমিশনের বিনিময়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অজুহাতে বর্ণিত সিন্ডিকেট গঠনে মূল ভূমিকা পালন করেন।”
প্রিন্ট মাস্টার ও মাস্টার সিমেক্স সম্পর্কে যা লিখেছে দৈনিক ইনকিলাব:
২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ নভেম্বর দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় “৭টি শিক্ষা বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তরপত্র তৈরি করছে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদপুষ্ট ৮ প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে বছরে শত শত কোটি টাকা” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শিক্ষার্থীদের টাকায় পরিচালিত দেশের সাতটি শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খাতা সরবরাহের নামে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদপুষ্ট মাত্র ৮টি প্রতিষ্ঠান হরিলুটের রাজত্ব কায়েম করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা ও শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তাদের যোগসাজসে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে ২০১৭ সাল থেকে এই ৮টি প্রতিষ্ঠানকে খাতা সরবরাহের এককছত্র ক্ষমতা প্রদান করে। যার বদৌলতে প্রতিষ্ঠান ৮টি দেশের ৭টি শিক্ষা বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পরীক্ষার খাতা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির মাধ্যমে গলাকাটা দর দিয়ে সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ২০১৭ সালের আগে কাগজ, ওএমআর সিট আলাদাভাবে ক্রয় করে টেন্ডারের মাধ্যমে সহজ শর্তে মুদ্রন ও তৈরি’র করে আসছিল। এর ফলে কোটি কোটি টাকা কমে খাতা তৈরি করে আসছিল বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। জুলাই-আগস্ট বিল্পবের পর ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরেরা আবারও আসন্ন এসএসসি ও এইএসসি পরীক্ষার খাতা সরবরাহের জন্য আগের নিয়মেই টেন্ডার (ইজিপি) করানোর মাধ্যমে ভাগাভাগির পাঁয়তারা শুরু করেছে। উল্লেখ্য, শিক্ষা বোর্ডগুলো সরকারি বরাদ্দ ছাড়াই পরীক্ষার ফরম পূরণসহ বিভিন্ন খাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া টাকায় পরিচালিত হয়ে থাকে।’
‘দেশের বিভিন্ন বোর্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, শিক্ষা বোর্ড-এর হর্তাকর্তা হলেন চেয়ারম্যান ও সচিব। শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজের প্রফেসর ও প্রভাষকদের প্রেষণে শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যান সচিবসহ অন্তত ৭টি পদে পদায়ন করে থাকে। পদায়নের ক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ একপ্রকার রীতিতে পরিণত হয়েছে। পেষণে আসার পর বছরের পর বছর এক জায়গায় থেকে অধিকাংশ কর্মকর্তা শিক্ষকতাই ভুলে যান। হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে থেকে জানা গেছে, মূলত ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষার খাতা তৈরিতে টেন্ডারের মাধ্যমে পৃথকভাবে কাগজ ও ওএমআর শিট ক্রয় করা হতো। পরবর্তীতে খাতার কভার মুদ্রণসহ তৈরির জন্য টেন্ডার আহবান করা হতো। মুদ্রণ ও খাতা তৈরির জন্য সাধারণত মুদ্রণালয় ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অংশ নিত। ফলে প্রতিযোগিতামূলক দর পড়তো। পাবলিক পরীক্ষা যেহেতু এই স্পর্শকাতর বিষয় তাই অনেক শিক্ষা বোর্ড নিজস্ব অর্থায়নে মুদ্রণযন্ত্র বোর্ড চত্বরে বসিয়ে মুদ্রণ কাজ করে সেখানেই ওএমআর (বোর্ডের সরবরাহ করা) দিয়ে খাতা তৈরি করে দিত। ঢাকা বোর্ডসহ কয়েকটি বোর্ড তাদের নিজস্ব ভবনেই টেন্ডার প্রাপ্তদের মুদ্রণযন্ত্র বসিয়ে খাতা তৈরির কাজটি সম্পন্ন করতো। ২০১৭ সাল পর্যন্ত একটি মূল খাতা তৈরিতে খরচ হতো সর্বোচ্চ ১১ টাকা। অতিরিক্ত ও ব্যবহারিক খাতা তৈরিতে খরচ পড়তো দুই ও দেড় টাকা। ২০১৭ সালে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদপুষ্ট ৫টি প্রতিষ্ঠান মোটা অংকের অর্থ দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলকভাবে খাতা তৈরির পথ রুদ্ধ করে দেয়। ওএমআর মুদ্রণ মেশিন থাকা আবশ্যকীয় করে জামানতের অংক বাড়িয়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খাতা সরবরাহের কাজ করে আসা অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেন্ডারে অংশগ্রহণের সুযোগ কেড়ে নেয়।’
‘রাজত্ব কায়েম হয় আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদপুষ্ট মাস্টার সিমেক্স, মনস্পুল, ইস্ট ওয়েজ ও এলিট ও এশিয়া প্রিন্টার্স, ইউনিসন পেপার প্রোডাক্ট, এস বি এস কর্পোরেশন, প্রিন্ট মাস্টার প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং নামে ৮টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে এশিয়া প্রিন্টার্স আইনি লড়াই করে এক থেকে দুটি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহের কাজ পায়। এরপরও বাকি ৬টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বেঁধে দেয়া গলাকাটা দর দিতে বাধ্য হয়। যদিও এশিয়া প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার উল্লেখিত ৬টি প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেটের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নাই বলে জানান। তবে তিনি এও বলেন, পত্রিকায় রিপোর্ট করে কী হবে? এর আগে দুদকে অভিযোগ করেও কোনো ফল হয়নি।’
প্রতিবেদন আরো বলছে, ‘বোর্ডগুলো থেকে প্রাপ্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে সিন্ডিকেট সৃষ্টির পর থেকে একটু রয়ে সয়ে দর বৃদ্ধি বা লুটপাট শুরু করা হয়। ছাত্র জনতার বিল্পবে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের আগে ২০২৩ সালে ডাকাতির মতো একেকটি খাতার দর প্রায় দ্বিগুণ করে দর দেয়া হয় এবং সরবরাহ করে বিলও উত্তোলন করা হয়। সূত্রটির মতে, ২০২১ সালে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে একটি অতিরিক্ত ও ব্যবহারিক উত্তরপত্র এক দশমিক ৪৪৯ পয়সা, ২০২২ সালে একটি মূল উত্তরপত্র ১৪ দশমিক ৭৯১ পয়সায় সরবরাহ করে সিন্ডিকেটধারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০২৩ সালে এ উত্তরপত্র সরবরাহ করা হয় ২২ দশমিক ৯৭১ পয়সা। কুমিল্লা বোর্ডে প্রতিটি ২৩ টাকা এবং ঢাকাসহ অন্যান্য বোর্ডেও ২২ টাকার বেশি দরে সরবরাহ করা হয়। সর্বকনিষ্ট শিক্ষা বোর্ড হিসাবে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে গত বছর (২০২৩) মূল উত্তরপত্র তৈরি করা হয় ৫০ লাখ। অন্যান্য বোর্ডে এর পরিমাণ আরো বেশি। দেশের ৭টি বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে কম করে হলেও ৮ থেকে ১০ কোটি মূল উত্তরপত্র তৈরি করা হয়। প্রতিটি উত্তরপত্রে ১০ টাকা করে বেশি দর দেয়ায় কত কোটি টাকা লুট করা হয়েছে তা দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষেই হিসাব করে বের করা সম্ভব। যদি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন মনোযোগী হয়। একইভাবে ২০২১ সালে অতিরিক্ত উত্তরপত্র তৈরি করা হয় মাত্র এক দশমিক ৪৪৯ পয়সা অর্থাৎ দেড় টাকারও কম। এ উত্তরপত্র ২০২৩ সালে শিক্ষা বোর্ডগুলো গ্রহণ করেছে ৮ দশমিক ৪৯১ পয়সা অর্থাৎ সাড়ে আট টাকার সামান্ন কম। অর্থাৎ প্রতিটি খাতায় বেশি দর দেয়া হয়েছে ৮ টাকারও বেশি। যদিও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড আলাদাভাবে কাগজ ও ওএমআর শিট ক্রয় করে নিজেদের মুদ্রণ যন্ত্রে কভার মুদ্রণ করে বহিরাগত বাইন্ডারদের দিয়ে একেকটি উত্তরপত্র মাত্র ১১ টাকায় তৈরি করে নজির স্থাপন করেছেন।’