স্মৃতির ফ্রেমে প্রফেসর এম শরীফুল ইসলাম | মতামত নিউজ

স্মৃতির ফ্রেমে প্রফেসর এম শরীফুল ইসলাম

বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে সুনামের সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে তার কাছে ছুটে আসতেন।

#অধ্যক্ষ #প্রফেসর এম শরীফুল ইসলাম #শিক্ষক

প্রফেসর এম শরীফুল ইসলাম একটি নাম, একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির মহাসম্পাদক এবং অধ্যক্ষ সমিতির সভাপতি। যিনি বাংলাদেশের শিক্ষকদের একটি সম্মানজনক অবস্থায় আনার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা লগ্ন থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে সফল হয়েছেন। শিক্ষকরা পেয়েছেন একটি সামাজিক মর্যাদা। শিক্ষকদের দাবি দাওয়া ও বেতন ভাতার জন্য পর্যায়ক্রমে তিনি শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে কলম তুলে দিয়ে আদায় করে নিয়েছিলেন শিক্ষকদের সম্মান মর্যাদা ও বেঁচে থাকার অধিকার।

বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে সুনামের সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে তার কাছে ছুটে আসতেন। তিনি তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে আন্তরিকতার সঙ্গে আপ্রাণ চেষ্টা করে সমস্যার সমাধান করতেন। কলেজই ছিলো তার বাড়ি ঘর। যতক্ষণ অফিসে থাকতেন শুধু শিক্ষকদের নিয়ে চিন্তা করতেন। তিনি এখানে শিক্ষকদের থাকা খাওয়ারও ব্যবস্থা করতেন।

মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ মূলত পরিচিতি লাভ করেছিলো তার নামের কারণেই। তিনি ছিলেন এক মহিরুহ। যার শীতল ছায়ায় সবাই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তিনি পরম ভালোবাসায় তাদেরকে আগলে রাখতেন। এইজন্য তিনি হতে পেরেছিলেন মহান শিক্ষক নেতা।

‘নিজের জীবন ও যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়

শিক্ষকদের জন্য করেছেন দান

গর্বিত শিক্ষক সমাজ আজ

যার সবটুকুই তারই অবদান।’

মো. আব্দুর রাজ্জাক। ছবি : দৈনিক শিক্ষাডটকমমো. আব্দুর রাজ্জাক। ছবি : দৈনিক শিক্ষাডটকম

রাত অবধি কলেজে থাকার কারণে এই মহান ব্যক্তিটির সান্নিধ্য পেয়েছি। তাকে অতি কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তার সময়ে জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার এবং বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, ডক্টর ওসমান ফারুক ও সাবেক সফল শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন কলেজে এসে কলেজকে সমৃদ্ধ করেছেন। আর আমাদেরকে করেছেন সম্মানিত ও গৌরবান্বিত। তিনি ছিলেন সবার প্রিয়ভাজন একজন ব্যক্তিত্ব যা তাকে মহিমান্বিত করেছে। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত একজন শিক্ষক নেতা। ইংরেজির ওপর ছিলো তার অপার দক্ষতা।

বাংলাদেশের শিক্ষাবিদদের তালিকায় যারা স্মরণীয় বরণীয় হয়ে আছেন তাদের কাছে প্রফেসর এম শরীফুল ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা ছিলো আকাশচুম্বি। প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমদ, প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, প্রফেসর ড. এসএমএ ফায়েজ, প্রফেসর ড. ওয়াকিল আহমেদ, প্রফেসর ডক্টর এরশাদুল বারী, প্রফেসর ডক্টর আফতাব উদ্দিন, প্রফেসর ডক্টর এম এ বারী, প্রফেসর ড. আমিনুল ইসলামসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সবাই তাকে ভালোবাসতেন। তিনি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট মেম্বার হিসেবে পদ অলংকৃত করেছেন। দিয়েছেন পরামর্শ ও সঠিক দিকনির্দেশনা। একজন নেতার যতগুলো গুণাবলী থাকা প্রয়োজন তার মধ্যে সবই ছিল।

গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে শিক্ষকদের সম্মেলনে তাকে শিক্ষকবন্ধু উপাধি দিয়েছিলেন। এটা শুধু তারই প্রাপ্য ছিলো। যিনি দিনে রাতে ঘর সংসার, সন্তান-সন্ততির মায়া না করে কলম হাতে রাত দিন অবহেলিত শিক্ষকদের জন্য লিখে গেছেন। শ্রদ্ধেয় স্যারের তিরোধানের পর আজও অনেক শিক্ষক নেতা, প্রফেসর তার গুণাবলী অর্জন করতে পারেননি। এখনো কেন্দ্রীয় কলেজে কনফারেন্স রুমে লেখা আছে ক্ষুধার্ত শিক্ষক দিয়ে তৃষ্ণার্ত শিক্ষার্থীদের জ্ঞানপিপাসা মেটানো সম্ভব নয়। তিনি কলেজকে রেখেছিলেন ধূমপান ও রাজনীতি মুক্ত। খারাপ কিছু দেখবো না, খারাপ কিছু শুনবো না, খারাপ কিছু বলবো না। এটা ছিলো শিক্ষকদের ও শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করার মূলমন্ত্র। সকল সরকারের মন্ত্রী এমপিরা তাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। আলহাজ্ব মকবুল হোসেন এমপি অনেকবার বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে গিয়ে বলতেন, অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে চাইলে প্রফেসর শরীফুল ইসলামের কাছে যান। তাইতো তিনি ছিলেন প্রিন্সিপাল অব দ্যা প্রিন্সিপাল।

তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক ও অভিভাবক। শিক্ষকরা কোনো ত্রুটি করলে বাইরের চাপ সামাল দিয়ে শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে তিনি সংশোধন করতেন। তিনি কাউকে কষ্ট দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তিনি যাদের উপকার করেছেন তাদের কাছ থেকে অনেক ব্যথা পেয়েছেন। কিন্তু তিনি ভুলে যেতেন এবং মাফ করে দিতেন। যা ছিলো তার চরিত্রের অন্যতম বিশেষ দিক। তার হাঁটাচলা, উপস্থাপনা, বক্তব্য, বাচনভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব যে কোনো মানুষকে মুগ্ধ করতো। আলোর দিকে যেমন পোকামাকড় আকর্ষণ করে তেমনি তার উদার মন-মানসিকতা ও ব্যক্তিত্বের জন্য সবাই তার কাছে এসেছে, তাকে ভালোবেসেছে।

শিক্ষার্থীরা তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। দরিদ্র পরিবারের ছাত্রদের বিনা বেতনে পড়াতেন। অনেক সময় পকেট থেকে টাকা দিতেন। আজ যারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত তারাও তাকে সমীহ করে কথা বলতেন। যা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি মেজাজি মানুষ ছিলেন। কিন্তু মনটা ছিলো খুবই নরম। তিনি সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতেন। এই জন্য সর্বদলীয় মানুষদের নিকট শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলেন।

তিনি কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। তাইতো স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের অবৈধ দাবি দাওয়া না মানার কারণে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিলো। শিক্ষকদের জন্য এরশাদ সরকারের আমলে তাকে হাজত বাস করতে হয়েছে। শত নির্যাতন, জেল জুলুম, হুলিয়ার কাছে তিনি মাথা নত না করে পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপায় বীরের বেশে দীর্ঘদিন পরে জেল থেকে মুক্ত হয়ে শিক্ষকদের মাঝে ফিরে আসেন। এরশাদ সাহেবের সঙ্গে একবার সংসদ ভবনের লিফটের ভেতরে কাকতালীয়ভাবে প্রফেসর শরীফুল ইসলামের দেখা হয়। এরশাদ সাহেব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি কেমন আছেন? উত্তরটা যেভাবে দেয়ার দরকার তিনি সেভাবেই দিয়েছিলেন।

তিনি ছিলেন বড় হৃদয়ের অধিকারী একজন ভালো মানুষ। লেখাপড়া করে আমাদেরকে ক্লাসে যেতে বলতেন। ভালো ফলাফল তৈরি করার ওপর গুরুত্ব দিতেন। ভালো মানুষ হওয়ার ওপরে জোর দিতে বলতেন। একবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভাল ফলাফল করেছে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে। শ্রদ্ধেয় স্যার আমাকে ডাকলেন। আমি বললাম, আমাদের ছেলে মোহাম্মদ সাঈদ মোল্লা তো প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে, সেই সঙ্গে আরো চার জন মেধা তালিকায় রয়েছে। স্যার খুশি হলেন। আমি সেই হাসি মাখা মুখখানা কখনো ভুলবো না। যা আজও আমার হৃদয় পটে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় প্রজ্বলিত হয়ে আছে।

স্যারের ঋণ আমি এবং আমার পরিবার কখনো শোধ করতে পারবো না। আজ তার দেয়া চাকরির কারণে আমি এত সুখী ও সমৃদ্ধ হয়েছি । শিক্ষক পল্লীর ফ্ল্যাটের জন্য তিনি আমার নাম লিখিয়েছিলেন। আমার আজকের অবস্থান, সম্মান যা কিছু সবকিছুই তার দয়া এবং দোয়া। তার আদর্শ ও দিকনির্দেশনা আমি ধারণ ও লালন করি। তার বিচক্ষণতা, ন্যায়পরায়ণতা, দূরদর্শিতা, তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান- যা সব সময় আমাকে মুগ্ধ করতো।

হঠাৎ একদিন শুনলাম স্যার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন । অনেক স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে হাসপাতালে দেখতে গেলাম। কাছে গিয়ে সুরা ফাতিহা, সূরা ইখলাস ও দরুদ শরীফ পড়লাম । বুকের ওপরে আস্তে করে মাথাটা রাখলাম। নিরব নিথর দেহ হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে। যেনো কতকাল ঘুমাননি। কলেজে এসে শিক্ষকদের কথা চিন্তা করতে করতে খাওয়া-দাওয়া, ওষুধ খাওয়া সবকিছুই ভুলে যেতেন। শিক্ষকদের জন্য কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন। তাই তো স্যার আজ গভীরভাবে ঘুমিয়ে আছেন। সেই ঘুমটাই আর ভাঙলো না। এই মহান ব্যক্তিটি আমাদেরকে চোখের জলে ভাসিয়ে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে। আমরা হারালাম একজন অভিভাবক । শিক্ষকরা হারালো শিক্ষকবন্ধুকে।

এই কর্ম পাগল মানুষটা রেখে গেলেন একটি সংগঠন, সেটাকে আমরা যদি যত্ন সহকারে পুনরায় দাঁড় করাতে পারি, তাহলে নতুন প্রজন্ম তার সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবে। আমরা পাবো তাকে মনে রাখার মত একটি প্ল্যাটফর্ম। বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর ভাতার টাকা তিনি নিজে গ্রহণ না করে শিক্ষকদের সুন্দর জীবন যাপনের জন্য চালু করে গেছেন। তিনি স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন আমাদের মানসপটে। আমরা সবাই তার কর্মের প্রতিদান হিসেবে দোয়া করি- আল্লাহ যেনো এই মানুষটিকে জান্নাতবাসি করেন।

লেখক: প্রধান, সমাজকর্ম বিভাগ, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ, ঢাকা

#অধ্যক্ষ #প্রফেসর এম শরীফুল ইসলাম #শিক্ষক