রাখাল রাহার জবানবন্দী | বই নিউজ

রাখাল রাহার জবানবন্দী

সেসময়েই ডেইলি ক্যাম্পাস, ঢাকা পোস্ট ইত্যাদির মতো কিছু এলোমেলো পোর্টালে আমাকে নিয়ে এবং আমাদের কাজ নিয়ে কিছু তথ্য, কিছু অর্ধসত্য আর কিছু মিথ্যা মিশিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিত রিপোর্ট প্রচার হতে লাগলো।

#পাঠ্যবই #কামরুল হাসান মামুন #এনসিটিবি

পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে যেসব ‘ইচ্ছেকৃত ভুল’ করেছিলাম এবং ‘যতো টাকা’ পেয়েছিলাম! শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটির সদস্য সাজ্জাদুর রহমান ওরফে রাখাল রাহা।

সোমবার (১০ মার্চ) রাতে তার নিজের আইডিতে তিনি এই স্ট্যাটাস দেন।

স্ট্যাটাসটি আমাদের বার্তার পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

সরকারের সাথে যুক্ত সবাই যখন ফেসবুকে এসে কৈফিয়ত দিচ্ছেন, তখন আমি সরকারের কোনো পদ গ্রহণ না করেও যে কিছু কাজ করেছি তার ভিতরের চিত্র প্রকাশ করা নিশ্চয়ই ভুল বা অন্যায় হবে না।

আর দুঃখিত যে, আমি বকতে পারি না, একটু লিখতে পারি। তাই এই দীর্ঘ লেখাটা আল্লাহর নাম করে একটু কষ্ট করে আপনাদের পড়তে হবে।

১.

কিভাবে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনা কাজের সাথে যুক্ত হলাম?

গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা যখন সন্তানের পাশে অভিভাবক সংগঠনের পক্ষ থেকে আহতদের আর্থিক ও মানসিক সাহায্য করার কাজ করছিলাম, তখন আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ স্যারের একটা মেসেজ পেয়ে আমি তাকে ফোন করলাম।

আরো পড়ুন: পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে প্রেস ব্রিফিং আজ

তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক, কিন্তু তার সাথে আমার আগে কখনো কথা হয়নি। তিনি আমাকে চিনতেনও না। তিনি ফোন ধরে তার পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনাদের শিক্ষাভাবনা এবং অ্যাক্টিভিজমগুলো আমি অনেকদিন থেকে খেয়াল করি। কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আপনাদের কথা ও লেখাগুলো আমি নানা সময়ে দেখেছি। সরকার থেকে আমাকে অনেকবার অনুরোধ করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে। আমি প্ল্যানিংয়ের মানুষ, তবে কেমব্রিজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকাল পড়িয়েছি। আপনাদের সহযোগিতা পেলে আমার জন্য কাজগুলো করা সহজ হবে।

তখন আমি আমার পরিচয় দিয়ে বলি যে, আপনি আমাকে তুমি করে বলুন, কারণ আমি আপনার ছাত্র। শিক্ষা ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আমি প্রায় তিন দশক ধরে লিখছি, কথা বলছি, কাজ করছি। আপনার সাথে কাজ করার সুযোগ পেলে খুশি হবো।

এরপর একাধিক মন্ত্রণালয় থেকে আরো কিছু দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ আসলেও আমি বিনীতভাবে তাদের বলি যে, আমি স্যারকে কথা দিয়েছি। অনেককিছু করতে গেলে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনার কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন আমাকে এমনটাও বলা হয় যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কি আমাকে কোনো পদ দেবে? বেতন দেবে? ওটা কি কোনো দায়িত্ব?

আমি তাদের বিনীতভাবে বলি, আমি আমার পছন্দের কাজটাই সারাজীবন করে গেছি। আয়-ইনকাম বা পদমর্যাদার কথা ভাবিনি।

২.

কিভাবে নতুন কারিকুলাম বাতিল হলো এবং অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ হিসেবে ২০১২-এর কারিকুলামে ফিরে যাওয়া হলো?

উপদেষ্টা স্যারের সাথে প্রথম আলাপের দিনই তিনি জানালেন, নতুন কারিকুলাম তো বাতিল করতেই হবে, কিন্তু কিভাবে করতে হবে, এ বিষয়ে ভাবতে হবে।

আমি তাকে তখনই জানাই, এখন আগস্ট মাসের মাঝামাঝি প্রায়, সময় নেই। তাই অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ২০১২ এর কারিকুলামে ফিরে যেতে হবে। কারণ এটা ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দেও কয়েকটি শ্রেণিতে চলমান আছে। আর নতুন কারিকুলাম চালু হয়েছে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। সুতরাং খুব বেশি সংকট হবে না। তবে এ বিষয়ে আমার ভাবনা ও পদক্ষেপগুলো আমি লিখে জানাবো।

এরপর আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে আমি কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক সংক্রান্ত একটা পরিকল্পনা তৈরি করে উপদেষ্টা স্যারকে দিই। স্যার সেখান থেকে তার বিবেচনা অনুযায়ী সংযোজন-বিয়োজন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

৩.

কারিকুলাম তৈরি ও পাঠ্যবই লেখার কাজ কিভাবে শুরু হলো?

এই কাজ কখনো শুরু হয়নি। কারণ আমরা কোনো কারিকুলাম তৈরি করিনি, পাঠ্যবইও লিখিনি। আমরা ২০১২ সালের কারিকুলামে প্রকাশিত বইয়ের সর্বশেষ সংস্করণ ২০২৩-২৪ খ্রিষ্টাব্দের বই পরিমার্জনার কাজ করেছি।

৪.

পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনার কাজ কবে থেকে শুরু হলো এবং কিভাবে শুরু হলো?

উপদেষ্টা স্যারের পরামর্শ অনুযায়ী এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর রবিউল কবির চৌধুরীর ফোন পেয়ে ৩১ আগস্ট পরিস্থিতি বোঝার জন্য প্রফেসর কামরুল হাসান মামুন, প্রফেসর সামিনা লুৎফা ও আমি এনসিটিবিতে যাই। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও অন্যান্যরা মিলে আমাদেরকে বলেন যে, সময় খুব কম। তেমন কিছু করা যাবে না। আগে ইন্টারমিডিয়েটের তিনটা বই ছেড়ে দিতে হবে। কারণ তাদের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে জুলাই থেকে। কিন্তু আগের সরকার বই দিয়ে যেতে পারেনি।

আমরা সেদিনই ইন্টারমিডিয়েটের বইগুলো নিয়ে বসে যাই। এবং পরিমার্জনা কাজের জন্য বিষয়ভিত্তিক টিম গঠন বিষয়ে আলাপ শুরু করি।

৫.

বিষয় ভিত্তিক টিম গঠন কিভাবে হলো?

উপদেষ্টা স্যারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রফেসর কামরুল হাসান মামুন, প্রফেসর সামিনা লুৎফা ও আমি বিষয় ভিত্তিক পরিমার্জনা টিমের খসড়া তালিকা তৈরি করি, এনসিটিবির বিশেষজ্ঞরাও এতে নানাভাবে মতামত দেন, কে থাকতে পারছেন বা পারছেন না ইত্যাদি জেনে সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে প্রায় ২ সপ্তাহ ধরে প্রথম ৪১ জনের তালিকা তৈরি করা হয়। এরপর সেটা এনসিটিবির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়।

প্রথম তালিকাটা মন্ত্রণালয় অনুমোদন করে দেয়। কিন্তু পরিমার্জনা কাজের ব্যাপ্তি বুঝে বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক টিমের সদস্যগণ আরও ১৬ জন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই সদস্যদের তালিকাও এনসিটিবির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় বেশ পরে।

কিন্তু ১৬ জনের তালিকা আমাদের কাজ চলাকালে মন্ত্রণালয় অনুমোদন করেনি। উল্টো জানানো হয়, এটা করা হবে না। কেন তারা এটা বললেন, তা বোঝার জন্য বাকি বিষয়গুলো ধৈর্য্য সহকারে পড়তে হবে।

৬.

আমি রাখাল রাহা কি কোনো বিশেষ দায়িত্বে ছিলাম? আমার কি কোনো পদ ছিল?

না, আমার কোনো পদ ছিল না, তবে দায়িত্ব ছিল।

উপদেষ্টা স্যার আমার সিভি নিয়েছিলেন, কিন্তু এটাকে ব্যবহার করেননি। আমি তাকে বলেছিলাম, কয়েকশত বইয়ের পরিমার্জনা, অনেক বড়ো কাজ, অনেক ঝুঁকি রয়েছে। এনসিটিবি বা মন্ত্রণালয় সব কিছু বলতে গেলে আগের মতোই রয়ে গেছে। সুতরাং কাউকে সার্বক্ষণিকভাবে বিষয়টা দেখতে হবে।

তিনি বলেছিলেন, কোনো পদ তৈরি করলে আমাদের নিন্দা হবে। কাজটা আমরা জাতীয় দায়িত্ব হিসেবে পালন করবো, সততার সাথে করবো। ওরা তো কিছু সম্মানী নিশ্চয় দেবে। আরও যদি দিতে হয়, তো আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে দেবো।

আমি বলেছিলাম, এনসিটিবি বাতিল হওয়া কারিকুলামের লেখকদের সম্মানীও এখন পর্যন্ত দেয়নি, আর সম্মানী যেটা দেয় তা তেমন কিছু না। অধিকাংশ মানুষ খাতির রাখার জন্য, বইয়ের গায়ে নাম থাকবে তা বেচার জন্য, বা ধান্দা উদ্ধারের জন্য কাজ করে, নষ্ট করছে জেনেও করে। তবে আমার পিঠে চাহিদার তেমন কোনো বোঝা নেই তো স্যার। সেই জন্য সবসময় সোজা হয়ে চলি। সুতরাং এটা নিয়ে ভাববেন না। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি যদি পুনর্বিন্যাস না করেন, কিছু দক্ষ-যোগ্য মানুষ না আনেন, তাহলে কাজ বাধাগ্রস্ত হবে, পিছিয়ে যাবে।

তিনি বলেছিলেন, না, আমি আছি, এখন কেউ কিছু করতে সাহস পাবে না। অল্প কিছু পরিবর্তন করলেই হবে। এবং সেভাবেই তিনি করলেন।

(টিকা: স্যার বা এনসিটিবি থেকে এখনো আমি কোনো সম্মানী গ্রহণ করিনি। কাউকেই এখনো কোনো সম্মানী দেওয়া হয়নি।)

৭.

পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের কোন কমিটি তবে বাতিল করা হয়েছিল?

পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনার কোনো কমিটি বাতিল করা হয়নি, পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনার কোনো কমিটি ছিল না, শুধুমাত্র বিষয় ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের দল ছিল। যেটা বাতিল করা হয়েছে তা হলো মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে গঠিত পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনা বিষয়ক একটা সমন্বয় কমিটি।

আমাদের কাজ শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই উপদেষ্টা স্যার আমাদের জানান যে আরেকটা সমন্বয় কমিটি করতে হবে মন্ত্রণালয় থেকে, যারা তোমাদের কাজ-সম্মানী ইত্যাদি অ্যাপ্রুভ করবে। না হলে নাকি সমস্যা হবে।

অভিজ্ঞতা থেকে এদেশের মন্ত্রণালয়গুলো সম্পর্কে কমবেশি সবার ধারণা আছে। আমরা বললাম, এটার কি দরকার আছে? এটা যেন আবার খবরদারির কমিটি না হয়। প্রত্যেক বিষয়-বিশেষজ্ঞ বুদ্ধি-বিবেচনা করে কাজ করছেন। তাদের কাজের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়ের নামে না বুঝে এলোমেলোভাবে মতামত দিলে ক্ষতি হবে।

তিনি বললেন, তোমরা স্বাধীনভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য যেটা ভালো সেটা করবে। তোমরা তো বেশি কিছু করছো না, কিছু সংশোধন ও পরিমার্জনা। আর কমিটিতে তোমরাও তো থাকছো।

এরপর মন্ত্রণালয় আমাদের তিনজনসহ যখন তাদের প্রস্তাবিত কমিটি পাঠালো, দেখলাম অনেক বড়ো একটা কমিটি, অধিকাংশ সদস্য মন্ত্রণালয়ের এবং যেখানে আমরা বলতে গেলে সংখ্যালঘু। আর এই কমিটির প্রধান মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব খ ম কবিরুল ইসলাম। দেখলাম কমিটির কার্যপরিধি অনেক, এবং সদস্য হিসেবে যে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষমতা তার ছিল।

এরপর মন্ত্রণালয় সেই কমিটি যখন পরিপত্র আকারে ওয়েবসাইটে ছেড়ে দিলো, তখন তা নিয়ে সারা দেশে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। বিশেষ করে পরিমার্জনার কাজে যুক্ত প্রফেসর কামরুল হাসান মামুন এবং প্রফেসর সামিনা লুৎফাকে নিয়ে নানা ধরণের প্রোপাগান্ডা চালিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবনকে হুমকির মুখে ফেলা হলো।

আমি উপদেষ্টা স্যারকে বললাম, প্রফেসর মামুন এবং সামিনাকে নিয়ে এলোমেলো লেখা হচ্ছে। এটা থামানো দরকার। তিনি বললেন, এই কমিটি তিনি বাতিল করে দিবেন।

আমি বললাম, এখন বাতিল করলে বিষয়টা আরো খারাপ হবে। বরং আমার মনে হয়, কিছু ইসলামী বিশেষজ্ঞ সদস্য অন্তর্ভুক্ত করে নিলে ভালো হবে। তিনি বললেন, এটা আর এখন করবো না, কমিটি বাতিল করে দেবো। আর কোনো কমিটিই করবো না।

আমি বললাম, কিন্তু প্রফেসর মামুন এবং সামিনার তো ক্ষতি হলো। আমি কিন্তু তাদের পক্ষে থাকবো। এবং যেটা করা প্রয়োজন করবো। তিনি বললেন, সেটা তুমি করো। এবং তিনি কমিটি বাতিল করে দিলেন। কিন্তু সারা দেশে সবাই মনে করলো এই কমিটিই পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের কাজ করছিল। আসলে তা নয়। এটা ছিল মন্ত্রণালয়ের মন মতো পাঠ্যবই যাতে তৈরি করা যায় তার জন্য গঠিত একটা কমিটি এবং সেই কমিটির প্রধান ছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব খ ম কবিরুল ইসলাম। স্বাভাবিকভাবেই সেই কমিটি বাতিল হওয়ায় অব্যাহতভাবে পরিমার্জনা কাজের ওপর তার খবরদারি করার প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ কমে যায়।

৮.

অতিরিক্ত সচিব খ ম কবিরুল সাহেব কবে থেকে মন্ত্রণালয়ে যুক্ত হলেন এবং কিভাবে তাকে চিনলাম?

সেপ্টেম্বরের ৫-৭ তারিখের দিকে উপদেষ্টা স্যার এনসিটিবিতে একটা মিটিং করলেন। সেখানে তিনি খ ম কবিরুল সাহেবকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

মিটিংয়ে এনসিটিবি-র পক্ষ থেকে যে প্রেজেন্টেশন দেওয়া হলো তাতে দেখানো হলো যে, হাসিনার বানানো নতুন কারিকুলামে যে বইগুলো ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে তা বাতিল করলে আগামী বছর শিক্ষার্থীদের বই পেতে জুন মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।

এর আগে আমরা যখন বিভিন্ন টেবিলে পরিমার্জনার কাজ করছিলাম, সেখানে এনসিটিবির বিশেষজ্ঞগণও এটা বলে আমাদের বাধাগ্রস্ত করছিলেন।

এটা দেখে আমি খুব কড়া ভাষায় বলেছিলাম, ওয়ান-টু-থ্রি ছাড়া নতুন কারিকুলামের কোনো বই আগামী বছর চলবে না। এর জন্য যা করা দরকার সেটা এনসিটিবি ও মন্ত্রণালয় করবে। এটার দায়িত্ব আমাদের না। আমাদের বলা হয়েছে ২০১২ সালের কারিকুলামের বই পরিমার্জনা করা হবে। সুতরাং আপনারা যখন যে বই চাইবেন, আমরা সেটা বুঝিয়ে দেবো।

এরপর আর হস্তক্ষেপ না করলেও এ বিষয়ে পরিমার্জনা টিমের সদস্যদের নানারকম কথা বলা অব্যাহত থাকে।

সেদিন মিটিংয়ে উপদেষ্টা স্যার সবাইকে স্পষ্ট করে বলেন যে, বই দেরি হতে পারে, আগের সরকারও সব বই সব স্কুলে জানুয়ারির ১ তারিখ দিতে পেরেছে তা নয়। কিন্তু বই কোয়ালিটি হতে হবে এবং বাতিল হওয়া নতুন কারিকুলামের কোনো বই যাবে না।

এরপর খাওয়ার টেবিলে খ ম কবিরুল সাহেব তার নানা কথা বলার এক পর্যায়ে আমাকে বললেন, আমরা সকল বই লিখে ফেলেছি, আপনাদের এতো পরিশ্রম করতে হবে না। আমাদের বইগুলো নিয়ে নিলেই হয়ে যাবে।

আমি বললাম, এতো অল্প সময়ে কি নতুন বই করা সম্ভব? তাড়াহুড়া করা ঠিক হবে না। এবার পরিমার্জনা করে আগের কারিকুলামের বই যাক, পরের বার আমরা ভাবতে পারবো।

সেই তাকে প্রথম চিনলাম এবং ভাবলাম, তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এলেনই ক’দিন মাত্র হলো। তিনি কবে সবগুলো বই লিখলেন? কারা লিখলেন? শত শত বই নতুন করে তৈরি করতে যা যা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় তা কি তিনি জানেন না?

সারা দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থীর পাঠ্যপুস্তক এভাবে করার কথা ভাবলেন কেমন করে? আমার মনে হলো, তিনি হয়তো এ বিষয়ে আর কথা বলবেন না। কিন্তু সেটা ছিল আমার ভুল।

৯.

মন্ত্রণালয়ের খ ম কবিরুল সাহেবের নেতৃত্বে হওয়া সেই কমিটি কি কোনো কাজ করেছিল?

সেই কমিটির ২টা মিটিং হয়েছিল। তারা শুরুতেই আমাদের সাথে আলাপ না করেই সচিবালয়ে প্রথম মিটিং ডেকে বসেন। এটা নিয়ে বাইরের সবাই খুব বিব্রত বোধ করতে থাকেন।

কারণ মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো ছিল না। কয়েকদিন আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মহোদয়ের সাথে মিটিং করতে গিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় ধরে মন্ত্রণালয়ের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল।

প্রফেসর মামুন ও সামিনা বললেন, কাজ হচ্ছে এনসিটিবিতে। সুতরাং মন্ত্রণালয়ের এনসিটিবিতে আসলেই তো সুবিধা। তারা মন্ত্রণালয়ে মিটিং করতে যাবেন না। সুতরাং আমিও গেলাম না।

সেই মিটিংয়ে তারা যেগুলো সিদ্ধান্ত নিলেন তার একটা হলো পুরাতন বই পরিমার্জনার কাজ না করে খ ম কবিরুল সাহেবের লেখা নতুন বইগুলোই বিশেষজ্ঞরা সম্পাদনা করবেন এবং সেগুলো মুদ্রণ করা হবে।

আরেকটা সিদ্ধান্ত হলো, তার বা তাদের লেখা জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে লেখা টেক্সটগুলো সব বিভিন্ন শ্রেণিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে।

কমিটির দ্বিতীয় মিটিং এনসিটিবি-তে হলো। এবং আগের মিটিংয়ের সিদ্ধান্তগুলো পাশ করানোর জন্য পড়ে শোনানো হলে আমি উক্ত সিদ্ধান্ত দুটি নিয়ে আমার মতামত দিলাম।

সম্পূর্ণ নতুন বই করা সম্ভব নয়, এটা উচিত নয় বলে সিদ্ধান্তটা পুনর্বিবেচনার কথা বললাম এবং উপদেষ্টা স্যারের মতামত নিতে বললাম।

জুলাই আন্দোলন বিষয়ক টেক্সট নিয়ে বললাম, কত নিকট ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে যেতে হয় এটা একটা শিক্ষাতাত্ত্বিক প্রশ্ন, আবেগের নয়। যে রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি, এখনও মানুষ হাসপাতালের বিছানায় শহীদ হচ্ছেন, সেই ইতিহাসের কতখানি টেক্সট পাঠ্যবইয়ে দেওয়া যায় তাও শুধু আবেগের বিষয় নয়, শিক্ষাতাত্ত্বিক বিষয়। মুক্তিযুদ্ধকে অতি ব্যবহার করে ধ্বংস করা হয়েছে, এখন জুলাইকে বাঁচিয়ে রেখে আমাদের জুলাই নিয়ে পাঠ রচনার কথা ভাবতে হবে। জুলাইয়ের সুফল মানুষের ঘরে যাওয়ার আগেই যেন আমরা জুলাইকে অতি মহিমান্বিত করতে অস্থির না হই। এটা হলে আমাদের ক্ষতি হবে। বার বার আমরা আমাদের সন্তানদের আত্মত্যাগ নষ্ট হতে দিতে পারি না। বইয়ের পেছনে আমরা জুলাইয়ের গ্রাফিতি অবশ্যই ব্যবহার করতে পারি। আর টেক্সট কতখানি দেওয়া যাবে না-যাবে বা কোথায় দেওয়া হবে, তা একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আমার কথায় সবাই প্রায় একমত হলেন, শুধু মনে হলো খ ম কবিরুল ইসলাম সাহেব একমত নন। তিনি মিটিং শেষেও এটা নিয়ে কথা বলতে থাকলেন।

১০.

খ ম কবিরুল সাহেবদের লেখা নতুন বই প্রচলনের চেষ্টা কতদিন চলেছিল?

খ ম কবিরুল সাহেব তার নতুন লেখা বইগুলো উপদেষ্টা স্যারকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু উপদেষ্টা স্যার তাড়াহুড়া করার পক্ষে ছিলেনা। তিনি একটু বিরক্তই হয়েছিলেন বোধহয়। তাই খ ম কবিরুল সাহেব সেপ্টেম্বরের পর আর এ বিষয়ে কথা বলেননি। তবে কমিটিটা যদি ঘটনাচক্রে বাতিল না হতো, তিনি হয়তো তার উদ্যোগ বাস্তবায়নে আরো বহু কিছু করতেন।

১১.

খ ম কবিরুল সাহেবদের পাঠ্যবইয়ে জুলাই অভ্যুত্থান বিষয়ক লেখায় ভরে দেওয়ার উদ্যোগের শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল?

সিদ্ধান্ত হলো প্রথমত বাংলা, ইংরেজি, সমাজ ইত্যাদি বইয়ের পেছনে গ্রাফিতি ব্যবহার করা হবে। দ্বিতীয় হলো প্রাথমিকের বাংলাতে শহীদদের নিয়ে ১টা, মাধ্যমিকের বাংলাতে পোষ্টার-গ্রাফিতির ভাষা নিয়ে ১টা এবং মাধ্যমিকের ইংরেজীতে গ্রাফিতি নিয়ে ১টা টেক্সট তৈরী করা হবে। টেক্সটগুলো এমন হবে যেন, আমাদের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় জুলাইয়ের স্বাভাবিকভাবে প্রতিস্থাপন হয়, অতিরঞ্জন মনে না হয়।

এতোটা নিকট ইতিহাসের বিষয় সমাজ বইয়ে আনা কিভাবে সম্ভব তা নিয়ে আমাদের মধ্যে নানা মত ছিল। তাছাড়া সমাজবিজ্ঞান বিষয়ক টিমের সিদ্ধান্ত ছিল ৭১-এর পরের কোনো ইতিহাস থাকবে না। সুতরাং সমাজ বা ইতিহাস বইয়ে জুলাইকে আনা সম্ভব হচ্ছিল না।

তখন খ ম কবিরুল সাহেব ‍শিক্ষা উপদেষ্টাকে পাশ কাটিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সহ নানা স্থানে বলতে লাগলেন এবং সেখান থেকে নানা সুপারিশ আসতে লাগলো।

আমরা সবসময়ই খ ম কবিরুল সাহেবকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, এ বিষয়ে এতো অল্প সময়ের মধ্যে যতোটুকু করা সম্ভব এবং যেটা উচিত সেটাই আমরা করার চেষ্টা করছি। তিনি ক্রমাগত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এনসিটিবির উপর চাপ অব্যাহত রেখে চললেন।

এক পর্যায়ে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা সরকারের সাথে যুক্ত উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে তার সাথে দেখা করলাম। তাকে আমরা পাঠ্যপুস্তকের বিষয়টা বুঝিয়ে বললাম। তিনি জেন-জি, নারীদের অংশগ্রহণ ইত্যাদিসহ বাংলা-ইংরেজী আরো কয়েকটা টেক্সটের কথা বললেন।

আমরা তার কথামতো আরো তিনটি টেক্সট নির্মাণ করলাম।

ইতিমধ্যে খ ম কবিরুল সাহেব জুলাই বিষয়ক টেক্সট নিয়ে বারংবার এনসিটিবি-র উপর তাগাদা দিয়েই চললেন। চেয়ারম্যান সাহেবকে আরো কিছু টেক্সট দিয়ে বললেন, এগুলো প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পাঠ্যবইয়ে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে, তিনি যেন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

ইতিমধ্যে একদিন শিক্ষা উপদেষ্টা স্যারও বললেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তাকে অনুরোধ করেছেন জুলাই বিষয়ে আরো কিছু টেক্সট তৈরি করার। তিনি সেটা আমাদের বিবেচনার জন্য অনুরোধ বললেন। আমাদের কাছে মনে হলো, উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের যুক্তিটা রাজনৈতিক, শিক্ষাতাত্ত্বিক নয়।

আমরা আবারও মাহফুজ আলমের অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে তার সাথে দেখা করলাম। সেদিন অভ্যুত্থানের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও ছিলেন। আমরা বললাম, বই বানালেই যদি সব হয় তবে হাসিনার বানানো বই পড়ে শিক্ষার্থীরা হাসিনাকে তাড়ালো কেন? আমরা অবশ্যই জুলাইকে ধারণ করবো, কিন্তু ধারণ করতে গিয়ে নষ্ট করতে পারবো না।

একটা ঐতিহাসিক ঘটনার পর তার উপর লেখা ভালো টেক্সট হতেও একটু সময় লাগে। গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ কোথা থেকে নির্বাচন করবো? এতো অল্প সময়ে পাঠ্যবইয়ের উপযোগী টেক্সট লেখা সম্ভব? যা কিছু ইচ্ছা কি পাঠ্যবইয়ে দেওয়া যায়? এটা কি উচিত?

আমরা বেশ দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো বললাম।

তিনি আমাদের কথা বুঝতে পারলেন এবং আর একটা অনুরোধ করলেন। নাহিদ ইসলামও তাঁর সাথে একমত হলেন। এবং আমরা ফিরে এসে সর্বোতভাবে চেষ্টা করলাম তাঁদের অনুরোধ রেখে পাঠ্যবইয়ে জুলাইয়ের টেক্সট নির্মাণের, এবং আমাদের ধারণা তাঁরাও আমাদের প্রতি খুশী হলেন।

কিন্তু খুশি হতে পারেন নাই মন্ত্রণালয় এবং বিশেষ করে খ ম কবিরুল ইসলাম সাহেব।

১২.

পাঠ্যবইয়ের অনুমোদন মন্ত্রণালয় কিভাবে দিলো?

প্রথমেই অনুমোদনের জন্য একটা কমিটি গঠন করা হয়, যার নাম এনসিসিসি, এটা অনেকটা ওয়ান টাইম কমিটির মতো। অনুমোদন শেষ, কাজ শেষ। পরের বছরের জন্য আবার অনেকটা নতুন করে করা হয়।

অক্টোবরের একেবারে শেষে খ ম কবিরুল সাহেব এনসিটিবিতে এলেন। আমাকে বললেন, কবে ছাড়বেন বইগুলো?

আমি বললাম, প্রাইমারির একটা বই বাদে সকল বই আমাদের টেবিল থেকে ছেড়ে দিয়েছি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে মাধ্যমিকের সকল বই চলে যাবে আমাদের কাছ থেকে।

তিনি বললেন, তাহলে ৭ তারিখেই এনসিসিসি-র মিটিংয়ের তারিখ ফেলি?

আমি বললাম, দুদিন হাতে রেখে ৯-১০ তারিখে ফেলতে পারেন।

এবং তিনি হাতে রাখলেন না, সম্ভবত ৭ তারিখেই মন্ত্রণালয় মিটিং ফেললেন এবং আমাকে সেই মিটিংয়ে রাখলেন না।

আমার কমিটিতে না থাকায় এনসিটিবি বিশেষজ্ঞ-কর্মকর্তারা একটু ঘাবড়ে গেলেন। তাদের মনে হলো মন্ত্রণালয় বইগুলোর অনুমোদন দেবেন না এবং না দিলে শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়বে। তারা অসহায়ভাবে আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যেন বিষয়টা উপদেষ্টা স্যারকে জানাই।

আমি উপদেষ্টা স্যারকে জানানোর পর তিনি বললেন, ওরা কিছু করবে না। ‍তুমি না থাকলেও হবে।

আসলে তিনি সবকিছু অনেক সহজভাবে বোঝেন বলে মনে হয়েছে। আমি বললাম যে, যদি অনুমোদন না দেয় তাহলে কিন্তু বই ছাপানোর কাজ পিছিয়ে যাবে।

পরে তিনি আমাকে জানালেন যে, তিনি বলে দিয়েছেন আমাকে মিটিংয়ে রাখতে।

সেই মিটিংয়ে এনসিটিবির পক্ষ থেকে বইগুলো উপস্থাপন করার পর সবাই কথা বললেন, প্রশ্ন করলেন। এরপর আমি আমার যুক্তি ও ব্যাখ্যা দেওয়ার পর মনে হলো সবাই একমত।

তখন সিনিয়র সেক্রেটারি সাহেব বললেন, তাহলে কিছু সংকট আছে তা এতো অল্প সময়ে নিরসন যেহেতু করা যাবে না, সেহেতু যেগুলো করা যাবে সেগুলো করা হবে ধরে নিয়ে আমরা বইগুলো অনুমোদন দিতে পারি।

তখন খ ম কবিরুল সাহেব বললেন, তার কিছু কথা আছে। এবং এরপর তিনি নবম শ্রেণির বাংলা বইয়ে বিভিন্ন হিন্দু লেখকদের নাম দেখিয়ে, বিভিন্ন টেক্সট দেখিয়ে বললেন, এগুলো কেন থাকবে? মাদরাসার বই দেখিয়ে বললেন, মাদরাসায় এসব গল্প-কবিতা কেন থাকবে? এগুলো সব পাল্টাতে হবে।

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। বাংলা গদ্য সাহিত্যের লেখকসূচি দেখলে হিন্দুলেখক নামগুলোই প্রথমে থাকে, কিন্তু পদ্য সাহিত্যের সূচি দেখলে সেখানে মুসলমান নামগুলো প্রথমে থাকে। এটা বাংলা গদ্য-পদ্য বিকাশের ধারা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এভাবে হিন্দু-মুসলমান দেখে নির্ধারণ করা ঠিক হবে কিনা, এমন প্রশ্ন তুললে, তিনি বলেন, এতোদিন কিছু হয়নি বলে এখন হবে না তা বলা যাবে না। সামাল দিতে পারবেন কিনা ভাবেন।

তার প্রচ্ছন্ন হুমকির পরও মন্ত্রণালয়ের কিছু সুপারিশ ও পর্যবেক্ষণ সহ আমাদের বই অনুমোদন হয়ে গেল। কিন্তু তখনও ভাবিনি যে তিনি ছেড়ে দেননি আমাদের।

১৩.

মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পরও বই নিয়ে কি কি করা হয়েছিল?

আমরা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুযায়ী কিছু কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করলাম। মাদ্রাসার বইয়ে যে কবিতা আছে সেটাকেই স্কুলের বইয়ে এনে আরও সমতা সৃষ্টির মতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম।

বইগুলোর সিডি প্রস্তুতের কাজ চলছিল। তখন আবার জানানো হলো মন্ত্রণালয় পাঠ্যপুস্তকের অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা কমিটি নামের আরেকটা কমিটি বানিয়েছে। জানতে পারলাম, এরকম কোনো কমিটির নজির আগে কখনো ছিল না এবং সেটা যেহেতু বিধি-প্রবিধির বাইরে তাই সেখানে স্বাভাবিকভাবেই কে থাকবে না থাকবে তা সম্পূর্ণ মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করেছে।

যাহোক সেই মিটিংয়ের জন্য বই মুদ্রণের সিডি করার কাজ থামিয়ে সবাই ব্যস্থ হয়ে পড়লেন। সেই মিটিংয়ে যখন ইতিহাস, বাংলা, পৌরনীতি ইত্যাদি বই এবং জুলাই অভ্যুত্থান বিষয়ক টেক্সট নিয়ে অনেক মতামত দিয়ে আবার পাঠানো হলো এনসিটিবি-র সবাই অনেকটা হায় হায় করতে লাগলেন।

আমি সেগুলো নিয়ে পরিমার্জনার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় বিশেষজ্ঞদের সাথে বসলাম। তারা যেভাবে বললেন এবং যতটা করা সম্ভব ছিল সেটা করে আবারও বইগুলো চূড়ান্ত করলাম।

যখন আবার সিডি তৈরি করার কাজ ‍শুরু হলো তখন মন্ত্রণালয় থেকে আবারও তাদের মতামত দেওয়া কপি এবং সংশোধিত কপিগুলো সব চাওয়া হলো।

আবারও সেটা দেওয়া হলো এবং সময় গড়াতে লাগলো। কিন্তু কপিতে তারা তাদের সবগুলো চাওয়ার প্রতিফলন না দেখে শেষে এনসিটিবি কর্তাব্যক্তিদের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেন, দেখা যাক রাখাল রাহা কতদূর যায়, আর উপদেষ্টা স্যার কতদিন থাকেন!

সেই যে কথাগুলো তিনি বলেছিলেন, তখন বিষয়টা তেমন গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু নভেম্বরের শেষ থেকে এ পর্যন্ত যা হয়ে চলেছে তাতে সেই কথাগুলো আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।

১৪.

আমাদের পরিমার্জনা দলের কারণে কি বই প্রকাশে দেরী হয়েছে?

না। যখন যে বইয়ের চুক্তি হবে, সিডি দেওয়া লাগবে এটা জানার সাথে সাথে আমরা সে বই ছেড়ে দিয়েছি। এটা আমরা বলে রেখেছি এবং এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ সেভাবেই আমাদের জানিয়েছে এবং এভাবেই আমরা সকল বই দিয়েছি। কিন্তু এইসব চুক্তি, সিডি তৈরী, মুদ্রণ বা টেন্ডার এগুলো কাজের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক বা সংযোগ ছিল না। কত কত হাজার কোটি টাকার কাজ হচ্ছে তা আমাদের একেবারেই ভাবনার বিষয় ছিল না।

১৫.

ঝামেলা বুঝতে পারলাম কখন থেকে?

নভেম্বরের শেষের দিকে আমি উপদেষ্টা স্যারকে বললাম যে, আমার কাজ তো শেষ, আমি ডিসেম্বরের এক তারিখে নিজের কাজে ফিরে যেতে চাই।

তিনি বললেন, তুমি আরো কিছুদিন থাকো। কারণ এলোমেলো হতে পারে।

এবং সত্যিসত্যিই দেখলাম, অনেকগুলো সেনসিটিভ বিষয়ে এলোমেলো হলো, বা করা হলো। নিশ্চিত যে আমি না থাকলে সেগুলো নিয়ে ভয়ঙ্কররকম বিতর্ক হতে পারতো, এমনকি বই বাতিল করতেও হতে পারতো।

সেসময়েই ডেইলি ক্যাম্পাস, ঢাকা পোস্ট ইত্যাদির মতো কিছু এলোমেলো পোর্টালে আমাকে নিয়ে এবং আমাদের কাজ নিয়ে কিছু তথ্য, কিছু অর্ধসত্য আর কিছু মিথ্যা মিশিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিত রিপোর্ট প্রচার হতে লাগলো। এনসিটিবির মধ্যকার কাজ না জানা দুয়েকটা গরু-গাধাও তাদের সাথে যোগ দিলো। দেশে-বিদেশে কিছু মানুষ ফেসবুক-ইউটিউবে আন্দাজে কথা বলতে লাগলো। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল এগুলো পোর্টাল-চ্যানেল-সেলিব্রেটিরা যেহেতু ভিউ বিজনেস করে, মানুষ এগুলো ততোটা বিশ্বাস করবে না।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখলাম বিপুল সংখ্যক মানুষ, যারা আমাকে চেনেনা জানেনা, তারা বিশ্বাস করছে। এমনকি, তাদের সাথে যোগ দিয়েছে এমন অনেকে যাদের সাথে একত্রে রাজপথে ছিলাম শুধু না, তাদের অনেকের বিপদে সর্বোচ্চ করার চেষ্টা করেছি, জেলখানায় গিয়ে খাবার-টাকা পৌঁছে দিয়েছি পর্যন্ত।

১৬.

সবাই তবে মিথ্যে, আমিই সত্যি?

এই প্রশ্নের উত্তর নেই বাংলাদেশে। কারণ দীর্ঘ দুঃশাসন, কুশিক্ষা আর প্রতারণায় এদেশে মানুষ আজ এমন অবস্থায় আছে যে, বিশ্বাস করতে পারে না এমন কিছু নেই এবং একই সাথে অবিশ্বাস করতে পারে না এমন কেউ নেই। না হলে আমাকে নয়--যারা এলোমেলো বলছেন-লিখছেন, একজন ব্যক্তির জীবনকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ করছেন, তাদেরই সবার আগে জিজ্ঞাসা করার কথা যে, তুমি কিসের ভিত্তিতে এটা বলছো বা লিখছো?

জবাবদিহি যে চাইছে, তার তথ্যই যদি ভুল হয়, উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়, তবে তো তাকেই সবার আগে জবাবদিহির মুখে ফেলার কথা।

১৭.

এখন তবে করণীয় কি আমার?

আমার কোনো পাসপোর্ট নেই, ছিলও না কখনো। পাসপোর্ট পকেটে রেখে আমি চলিনি, চলবো না। কারণ দেশটা আমার বাপেরও।

#পাঠ্যবই #কামরুল হাসান মামুন #এনসিটিবি