দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি এবং সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতকরণে অবসরে যাওয়া জেলা জজদের তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে আসন্ন বাজেটে ‘জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে এডিআর ও মেডিয়েশন সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্প নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১০ কোটি টাকা।
প্রকল্পের আওতায় নিয়োগ পাওয়া জজদের জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থায় (লিগ্যাল এইড) পদায়ন করা হবে। সেখানে তারা বাদী ও বিবাদীদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে (এডিআর) মামলা বা বিরোধ নিষ্পত্তি করবেন। এ জন্য জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন ও বিধি সংশোধনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আইন ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশে বর্তমানে ৪৫ লাখ মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে অধস্তন আদালতেই বিচারাধীন প্রায় ৪০ লাখ মামলা। অথচ ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথক্করণের সময় দেশে বিচারাধীন মামলা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। তথ্য পর্যালোচনা বলছে, দেড় যুগে মামলাজট হয়েছে তিন গুণ।
সরকার ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের নানামুখী উদ্যোগের পরও আদালতে মামলাজট কমছে না; বরং মামলার তুলনায় নিষ্পত্তি কম হওয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে এ জট। ২০২৪ সালেও আদালতে মামলাজট বেড়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৪টি। মামলা বাড়ার তথ্য অনুযায়ী এ হার গত এক যুগে সর্বোচ্চ। এ পরিস্থিতিতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা (এডিআর), অর্থাৎ আপস-মীমাংসার মাধ্যমে মামলা বা বিরোধ নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।
এ ব্যাপারে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘লিগ্যাল এইড সংস্থার মাধ্যমে গত বছর ৩৫ হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। সংস্থাটিতে বছরে দুই লাখ মামলা নিষ্পত্তি করা গেলে আদালতে মামলার চাপ কমপক্ষে ৪০ শতাংশ কমবে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসগুলোতে মাত্র একজন করে সহকারী/সিনিয়র সহকারী জজ পদমর্যাদার বিচারক কাজ করছেন। এসব অফিসে একজন সিনিয়র সহকারী জজ, একজন যুগ্ম জেলা জজ এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ নিয়োগ দেওয়া হবে।’আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মামলাজট নিরসনে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন থেকেও প্রস্তাব করা হয়েছিল। যেসব জেলায় মামলাজট বেশি, সেখানে দুই বা তিন বছরের জন্য অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষ আদালত আইন-২০০৩ সংশোধনের মাধ্যমে এবং ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের ৪৯ ধারা অনুসারে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের নিয়োগ করা যেতে পারে।
এরই ধারাবাহিকতায় ‘জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে এডিআর ও মেডিয়েশন সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পটি নিয়েছে মন্ত্রণালয়। আইন সংশোধন করে লিগ্যাল এইডের কার্যপরিধি বাড়াতে খসড়া অধ্যাদেশ প্রণয়নের কাজ চলছে। লঘু অপরাধে দায়ের হওয়া ফৌজদারি মামলা, পারিবারিক বিরোধ-সংক্রান্ত মামলা, পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত চেক ডিজঅনার, ছোটখাটো দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তির এখতিয়ার লিগ্যাল এইডকে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ মেহেদী হাসান বলেন, ৬৪ জেলায় একজন করে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। বাজেটে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
লিগ্যাল এইড সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ পর্যন্ত ৬৪ জেলায় ৪ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৭ জন সরকারিভাবে আইনি সহায়তা নিয়েছেন। একই সময়ে লিগ্যাল এইডের আওতায় নিষ্পত্তি হয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার ১৫১টি মামলা। ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর সরকারি আইনগত সুবিধাভোগী ক্রমাগত বেড়েছে। এ পর্যন্ত সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫।
মামলাজট নিরসন প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, মামলাজট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরেও মামলাজট থেকে বিচারপ্রার্থীরা রেহাই পাবেন না।