প্রতিষ্ঠার ৭২ বছরে পা রেখেছে লোকমুখে প্রচলিত প্রাচ্যের কেমব্রিজখ্যাত বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার ছয় যুগে প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠে অনেক জ্ঞানতাপস তৈরি হয়েছে। জরাজীর্ণতা কাটিয়ে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন নানান স্থাপনা। ব্ল্যাকবোর্ডের পরিবর্তে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আধুনিক প্রজেক্টরে শুরু হয়েছে পাঠদান। তবে উচ্চশিক্ষা, গুণগত গবেষণা বরাদ্দসহ আবাসন সমস্যার মতো নানান সংকট এখনোও রয়ে গেছে। ফলে প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তথ্য বলছে, ১৬১ জন নিয়ে যাত্রা করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ১ হাজার ১২ জন শিক্ষক ও বিপুলসংখ্যক গবেষক। ৭৫৩ একরের ক্যাম্পাসজুড়ে ১২টি অনুষদ, ৫৯টি বিভাগ ও ৬টি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ আধুনিক অবকাঠামো রয়েছে। ১৪টি অ্যাকাডেমিক ভবন, ১৭টি আবাসিক হল, আন্তর্জাতিক ডরমিটরি, গ্রন্থাগার, আইসিটি সেন্টার, জাদুঘর, স্টেডিয়াম, সুইমিংপুলসহ বিভিন্ন সুবিধাও রয়েছে।
শিক্ষা ও গবেষণায় দেশি ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গৌরবজনক অবস্থান গড়ে তুলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী মসলিন পুনরুদ্ধার, পানিকে আর্সেনিক দূষণমুক্ত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গ্রিন চিলি পাউডার ও সজনে পাতার গুঁড়া তৈরি এসব সাফল্যের অন্যতম। এ ছাড়া সফলতার মধ্যে রয়েছে চার সবজি থেকে ক্যানসারপ্রতিরোধী গুণ ও তুঁত গবেষণায় ক্যানসার ও হৃদরোগপ্রতিরোধী আবিষ্কার, পাটের বিকল্প আঁশ উদ্ভাবন, উন্নত প্রজাতির মাছ গবেষণা ও বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছের আট প্রজাতি হাওরে ফিরিয়ে আনা, বিরল অর্কিড কাঞ্চন, ফুলের জীবন্ত চিত্রকর্ম, মাটি ছাড়া ঘাস ও আনারস চাষে টিস্যু কালচার প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সফলতা।
সম্প্রতি লবণ ছাড়া চামড়া সংরক্ষণের টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে দেশে প্রথম সফল গবেষণা করেছেন ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম। প্লাজমা টেকনোলজি ব্যবহার করে কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছেন ইইই বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুনুর রশিদ তালুকদার। পদার্থবিদ্যায় রাবির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার বসাকেরও রয়েছে সফলতা। এসব গবেষণা দেশের বাস্তব ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব রাখছে।
এদিকে উচ্চশিক্ষায় রাবি শিক্ষার্থীদের সফলতাও বেড়ে চলছে। সর্বশেষ তথ্যে গত ছয় মাসে ৩৪ জন উচ্চশিক্ষায় বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ ও একই ল্যাবের পাঁচ শিক্ষার্থী সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পৃথক চার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণায় ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়েছেন।
গবেষণায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মর্যাদা পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। সর্বশেষ যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল নেচার ইনডেক্স র্যাঙ্কিং মার্চ ২০২৫ অনুযায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মধ্যে গবেষণায় শীর্ষস্থান দখল করেছে। এর আগে স্কোপাসের জরিপে দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গবেষণায় সবার শীর্ষে অবস্থান করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।গুগল স্কলারে রিসার্চ সাইটেশনে দ্বিতীয়, ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’র ইমপ্যাক্ট র্যাঙ্কিং-২০২৫–এ যৌথভাবে চতুর্থ,
অ্যালপার ডগার সায়েন্টিফিক ইনডেক্স র্যাঙ্কিং-২০২৫ এ দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সম্মিলিতভাবে তৃতীয় ও সিমাগো র্যাঙ্কিংয়ে ৫ ধাপ এগিয়ে ৮ম স্থান অর্জন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ইউএস গ্লোবাল নিউজ র্যাঙ্কিং ২০২৫ অনুযায়ী বিশ্বের গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এর অবস্থান ৬৩৮তম। তা ছাড়া বিশ্বসেরা ২ শতাংশ বিজ্ঞান গবেষকের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীবসহ ১৫ জন গবেষক স্থান পেয়েছেন।
অন্যদিকে রাবিতে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি শিক্ষার্থীসহ ভর্তি হয়েছেন ১৮ বিদেশি শিক্ষার্থী। বর্তমানে ৯টি দেশের ৩৩ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন পর্যায়ে অধ্যয়ন করছেন।
১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় রাবির আইন অনুষদের ২৮ জন শিক্ষার্থী সুপারিশপ্রাপ্ত হন। বিজেএস ছাড়িয়ে সম্প্রতি বিসিএসেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতা চোখে পড়ার মতো।
পররাষ্ট্র ক্যাডারে চতুর্থ ও অ্যাডমিনে পঞ্চমসহ ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৬২ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। অন্যদিকে গত চার বছর টানা ১ম স্থান অর্জনসহ সবশেষ ১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষাতেও রাবির আইন অনুষদ থেকে ২৮ জন শিক্ষার্থী সহকারী জজ হিসেবে মনোনীত হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক মো. আখতার হোসেন মজুমদার বলেন, বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকাডেমিকভাবে সন্তোষজনক অবস্থানে রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক গবেষণায়ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান তৈরি করেছে। তবে আমাদের দায়িত্ব হলো বাজার চাহিদাভিত্তিক গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা। এ জন্য কারিকুলাম আধুনিকায়নের চেষ্টা চলছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু ক্ষেত্রে সফলতা থাকলেও সংকটও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। আবাসন সংকটও বেশ পুরোনো। তৃতীয় বর্ষে পড়েও রাবির অনেক শিক্ষার্থী এখনো হলে আসন পাচ্ছেন না, যা শিক্ষাজীবনের মান ও মনোবলের জন্য বড় সংকট সৃষ্টি করছে। বর্তমানে ১৭টি আবাসিক হল রয়েছে। অবশ্য নতুন আরেও একটি হল নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রায় ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১০ তলা আবাসিক হলটির কাজ শেষে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ড. মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান বলেন, আবাসিক সংকট কাটিয়ে উঠতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এরই মধ্যে নতুন পাঁচটি হল নির্মাণের প্রস্তাব সরকারে প্রেরণ করেছে। এর পাশাপাশি ছেলেদের একটি নতুন হলের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। ডিসেম্বরের মধ্যেই সেখানে ১১ শতাধিক শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পাবে। মেয়েদের একটি হলের কাজও শেষের দিকে। আগামী বছরেই উদ্বোধন করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিয়োগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।