২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইয়ে কোটা বাতিলের আন্দোলন শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেই আন্দোলনে নাকাল হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারকে। প্রাণহানি হয়েছে অনেক, অথচ সেই কোটার অভিশাপ পুরনো পথেই ফিরতে যাচ্ছে।
কোটা বলতে কোনো কিছুর নির্দিষ্ট একটি অংশকে বোঝায় যা সাধারণত একটি গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ থাকে। মূলত সমাজের পিছিয়ে পড়া বা অনগ্রসর মানুষগুলোকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে পড়াশোনা, চাকরিসহ নানা ক্ষেত্রে কোটার ব্যবস্থা থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই কোটা পদ্ধতি চালু আছে। বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে থেকেই চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, জেলা ও নারী কোটা ছিল। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন কর্পোরেশন ও দপ্তরে নিয়োগ এবং কোটা বণ্টনের বিষয়ে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের পাঁচই সেপ্টেম্বর তৎকালীন সরকার একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে। এতে এসব প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ মেধা এবং বাকি ৮০ শতাংশ জেলা কোটা রাখা হয়। এই ৮০ শতাংশ জেলা কোটার মধ্য থেকেই ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধা এবং ১০ শতাংশ কোটা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার হিসেবে দেওয়া এ বিশেষ সুবিধা পরবর্তী পাঁচ দশকে তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইয়ে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিলে ৫ আগস্ট পতন ঘটে তৎকালীন সরকারের। অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর কোটা আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী ও শহীদদের স্বজনদের অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেয়ার উদ্যোগ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। সর্বশেষ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের চাকরিতে বিশেষ সুবিধা দেয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। সুবিধা দেয়ার এ নীতিকে পুরনো কোটা ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের কোটা আন্দোলনের নেতা বর্তমানে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, প্রত্যেকটা সফল আন্দোলন-সংগ্রামের পর বিজয়ীরা নিজেদের বেনেফিশিয়ারি গ্রুপ তৈরি করতে চায়। শেখ মুজিব মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালুর মাধ্যমে যেটা করেছিলেন। চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর তেমন কিছু ঘটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু যে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্রজীবন থেকে আন্দোলন করেছি, জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছি, সে কোটা আর কখনই ফিরে না আসুক। তবে অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত ভাই-বোনদের এককালীন বা মাসিক ভাতাসহ চাহিদামাফিক বিভিন্নভাবে পুনর্বাসন করা যেতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের চাহিদামাফিক সহযোগিতার মাধ্যমে অবশ্যই রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়ানো দরকার। কিন্তু কোনোভাবেই চাকরিতে কোটা বা বিশেষ সুবিধা দিয়ে নয়।
গত ২৪ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, গেজেট আকারে ৮৩৪ জন ‘জুলাই শহীদের’ তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রত্যেক জুলাই শহীদ পরিবার এককালীন ৩০ লাখ টাকা পাবেন। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রত্যেক পরিবারকে ১০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে। আর বাকি ২০ লাখ টাকা দেয়া হবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে অর্থাৎ আগামী জুলাইয়ে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে। তাছাড়া শহীদ পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে ভাতা দেয়া হবে। শহীদ পরিবারের সক্ষম সদস্যরা অগ্রাধিকার পাবেন সরকারি ও আধাসরকারি চাকরিতে।
এ বিষয়ে উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, এটা ওইভাবে দেখার বিষয় না। চাকরির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেওয়া কোনো কোটা ব্যবস্থা নয়। যদি চাকরির জন্য যোগ্য হয়, তাহলেই তাদের পুনর্বাসন করা হবে। ধরুন স্ত্রী রেখে একজন শহীদ হয়েছেন। তার বিধবা স্ত্রী যাবেন কোথায়? উনার মতো ক্ষতিগ্রস্তদের কথা ভাবা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে রকম কোটা ছিল, এটা সে রকম কোনো কোটা ব্যবস্থা না।
উপমহাদেশে কোটা ব্যবস্থার ইতিহাস বেশ পুরনো। প্রাচীন ভারতে পুরোহিত, যোদ্ধা, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের জন্য পৃথক কোটা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। তবে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে মহারাষ্ট্রের কোলাপুর রাজ্যের মহারাজা ছত্রপতি সাহু প্রথমবারের মতো অ-ব্রাহ্মণদের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করেন। ব্রিটিশ-ভারতে সিভিল সার্ভিসে ভারতীয়দের জন্য ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে আলাদা কোটার ব্যবস্থা করা হয়। অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে সিভিল সার্ভিসে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের জন্য ৪০ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি কর্মচারী নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ ও যুদ্ধাহত নারীদের জন্য ১০ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ জেলা কোটা চালু করা হয়। সে সময় মেধা কোটা রাখা হয়েছিল মাত্র ২০ শতাংশ। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মেধা কোটা ২০ শতাংশ বাড়িয়ে বরাদ্দ হয় ৪০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা আগের মতোই ৩০ শতাংশ রাখা হয়। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৪৫ শতাংশ, জেলা কোটায় ১০ শতাংশ ও নারীদের জন্য ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষণ করা হয়। সে বারও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। তবে প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ কোটা চালু করা হয়।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ সরকার ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উপযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী পাওয়া না গেলে মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র-কন্যার জন্য তা বরাদ্দের আদেশ জারি করে। তবে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৩০ শতাংশে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা তালিকার প্রার্থী থেকে নিয়োগের নির্দেশ দিয়ে পরিপত্র জারি করে। যদিও ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এ নির্দেশনা বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ করা সম্ভব না হলে পদ খালি রাখার নির্দেশ দেয়। পরে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদেরও ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্তর্ভুক্ত করে। আর ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরপর থেকে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে কোটার বিন্যাস ছিল—মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ (মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনি), নারী ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের বিধান ছিল ৪৫ শতাংশ। তবে ৫৫ শতাংশ কোটায় পূরণযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে ১ শতাংশ পদে প্রতিবন্ধী নিয়োগের বিধান চালু করা হয়।
সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে কোটার পরিমাণ বেশি থাকায় বরাবরই সাধারণ শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ থাকলেও ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে তা বড় আকার ধারণ করে। তুমুল জনবিস্ফোরণের মুখে ১১ এপ্রিল সংসদে দাঁড়িয়ে সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বছরের অক্টোবরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বাতিল এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদগুলোয় কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকে নিয়োগের নির্দেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
এদিকে, কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জুন আগের মতোই কোটা বহালের নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। এর প্রতিবাদে ১ জুলাই থেকে কোটা বাতিলের আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। জুলাইয়ের প্রবল আন্দোলনের চাপে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে মোট ৭ শতাংশ কোটা রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এতে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা রাখা হয়। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে’ এ আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হলে সরকারের পতন হয়। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলনের ফসল অন্তর্বর্তী সরকার সেই ৭ শতাংশ কোটাই বহাল রাখে। সেই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের পাশাপাশি অভ্যুত্থানে হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের অর্ন্তভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। যদিও সমালোচনার মুখে সরকার এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।
সে সময় এ সিদ্ধান্তকে অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা। ৫ আগস্ট-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের অনানুষ্ঠানিক কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ছাত্র কোটায় উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে বলা হয় তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখলাম যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিল সব ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের সম্মিলিত প্লাটফর্ম, সেখান থেকে সব ছাত্র সংগঠনের পদধারী নেতাকর্মীদের বের করে দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে চালু করা হয় সমন্বয়ক কোটা। এরপর আরেকটি কোটা চালু করা হয়, সেটি হলো বিভিন্ন সংস্কার কমিশনে ছাত্র প্রতিনিধি কোটা। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কোটা চালু করেছে এবং করার চেষ্টা করছে, যা জুলাইয়ের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি।
এদিকে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে আহত ও শহীদ পরিবারের জন্য বিশেষ সুবিধার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। গত মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তিতে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গেজেটভুক্ত শহীদ এবং তালিকাভুক্ত আহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার কথা বলছে। শুধু তা-ই নয়, নাতি-নাতনিদের কোটা নিয়ে মন্তব্য করার জন্য শেখ হাসিনাকে যে সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়েছিল, ঠিক এবার নাতি-নাতনিদের ভর্তি সুবিধা না দিলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, জুলাই শহীদের পরিবারের সদস্য হিসেবে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে বিশেষ সুবিধা পাবেন। স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে না থাকলে শহীদ ও আহতদের ভাই-বোন এ সুবিধা পাবেন। যদিও সমালোচনার মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, বিশেষ এ সুবিধা কোটায় নয়, বরং আর্থিক সুবিধায় সীমাবদ্ধ থাকবে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো পোষ্য কোটা বিদ্যমান। এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে পোষ্য কোটাসহ ১১ ধরনের কোটার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এগুলো হলো প্রতিবন্ধী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, খেলোয়াড়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, অ-উপজাতি (পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী বাঙালি), বিদেশী শিক্ষার্থী, দলিত, চা-শ্রমিক, বিকেএসপি (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) ও উপাচার্য কোটা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মতো প্রকৃতপক্ষে অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোটা সুবিধা থাকা দরকার। কেননা, সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতেই কোটা ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু বছরের পর বছর শুধু কোটাতে ভর করে না থেকে বৈষম্য দূরীকরণে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা উচিত। রাষ্ট্রীয় নীতি এমন হওয়া উচিত যেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি মানুষ নাগরিক সুযোগ-সুবিধার আওতায় আসে। তাহলে আর কোটার প্রয়োজন হবে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে পোষ্য কোটা রাখার পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, একজন ব্যক্তি সারা জীবন যেখানে শ্রম দেন সেখানে নিজের সন্তানকে পড়াতে না পারা আক্ষেপের। তাই অন্তত সন্তানদের জন্য পোষ্য কোটা রাখা যেতে পারে। তবে অবশ্যই ওই শিক্ষার্থীর ভর্তির মৌলিক যোগ্যতা থাকতে হবে।
২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে। এ সময় শিক্ষার্থীদের চার দফা দাবির মধ্যে ছিল ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখা; কমিশন গঠন করে সরকারি চাকরিতে (সব গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিয়ে কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রাখা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করা। যদিও ৫ আগস্টের পরও সরকারি চাকরিতে ৭ শতাংশ কোটা বহাল রয়েছে।
বিদ্যমান এ কোটা শিক্ষার্থীদের চার দফা দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব মাহিন সরকার বলেন, আন্দোলন শুরুর আগে জরিপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে মতামত জানতে চাই। ছাত্রদের দাবি ছিল কোটা সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ রাখা। এর বেশি কোনোভাবেই না; কম হলে ভালো হয়। তবে আন্দোলন চলাকালে সরকার ৭ শতাংশ কোটার ঘোষণা দেওয়ার পর নেগাসিয়েট করে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব ছিল। কিন্তু আবু সাঈদসহ শতাধিক সহযোদ্ধা শহীদ হওয়ার পর আলোচনার আর সুযোগ ছিল না। তবে ৭ শতাংশ কোটা ছাত্রদের চাওয়ার সঙ্গে খুব বেশি সাংঘর্ষিক নয়। তবুও ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনলে ভালো হয়। বিষয়টি সরকারকে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান তিনি।