আমি আজ এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট আমার মতো করে পর্যালোচনা করতে চাই। বিশেষ করে ১৩৪ স্কুলের ফলাফল আমাকে ভাবনায় ফেলেছে। কারণ ১৩৪ স্কুলের কেউই পাস করতে পারেন নাই। পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে গত দশ বছরের মধ্যে এবারের রেজাল্ট সর্বনিম্নের অর্থাৎ ৬৮.৪৫ শতাংশ। কিন্তু রেজাল্টের গুণগত মান বিচার করলে এটিই বিগত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফলাফল হতে পারে। প্রতি বছর যা করা হয়েছে বোর্ডগুলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর জন্য প্রতিযোগিতা মূলকভাবে সরকারকে খুশি করার জন্য রেজাল্ট দিয়েছে।
শিক্ষক পরীক্ষকদেরকে বিভিন্নভাবে বেশি নম্বর দেয়ার জন্য বোর্ড কর্তৃপক্ষ মনগড়া যুক্তি দিয়েছে। যা শত শত শিক্ষক আমাদেরকে জানিয়েছেন। এমনও বলেছে যে লেখা থাকলে নম্বর দিতে হবে। প্রয়োজন বাম হাতে লিখে নম্বর দিবেন। দিবেন না কেন? না দিলে, আমরা আপনাদেরকে পরে খাতা দেখতে দিবো না। বেশিরভাগ হেড এক্সামিনার যিনি, তিনিও ছিলেন মেরুদণ্ডহীন গোলাম। ব্যতিক্রমও ছিলে।অবশ্য করারও কিছু ছিলো না। তারাও নানাভাবে পরীক্ষককে চাপ সৃষ্টি করেছেন বলে জানা যায়। এবার এমনটা হয়নি বা তুলনামূলক কম হয়েছে। কারণ বেশি নম্বর দেয়ার অভ্যাস তো আর এতো তাড়াতাড়ি পরিবর্তন করা যায় না। আমি মনে করি ৬৮ শতাংশ পাস এটাই এদেশের প্রকৃতচিত্র। বিগত দশ বছর প্রকৃতচিত্র দেখা যেতো না। শিক্ষা উপদেষ্টা সহানুভূতির বা খয়রাতি নম্বর দিতে নিরুৎসাহিত করেছেন সেজন্য তাকে শিক্ষক অভিভাবক সমাজ সাধুবাদ জানিয়েছেন। কারণ তিনি চান মানসম্মত শিক্ষা। ৮৩ শতাংশ থেকে কমে ৬৮ শতাংশ! সবচেয়ে বড় বিষয় এই পরিবর্তনের পেছনে ‘অথেনটিক অ্যাসেসমেন্ট’ কৌশল, প্রশ্নপত্র কঠোরতা বা মূল্যায়নের যথার্থতা, মান বাড়ানোর বা উত্তর পত্র সঠিকভাবে যাচাই করা কৌশল থাকতে পারে।
এবার আসা যাক সেই ১৩৪ স্কুলের বিষয়ে। প্রথমেই এইসব স্কুলের পরীক্ষার্থীর জন্য সমবেদনা প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে হয়তো তোমারা ভাল করবে। ১৩৪টি ‘জিরো পাস’ স্কুল জনগণের মনে প্রশ্ন তোলে তাদের অবস্থা ও দায়ভার সম্পর্কে। প্রশ্ন হলো প্রধান শিক্ষক, শিক্ষকদেরকে নিয়ে। উনারা পাঁচ বছর ধরে পড়িয়ে একজনকেও পাসের উপযোগী করে তুলতে পারলেন না। কি করলেন? জেলা শিক্ষা অফিস, উপজেলা শিক্ষা অফিস তাদের দায়ভার কি নেই? আচ্ছা, টেস্ট পরীক্ষায় নিশ্চয়ই পাস করেছিলো। ফর্ম ফিল আপ কিভাবে করলো? কেউ দেখার নেই। একটি খসড়া হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর ১৩৪ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য সরকারের প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ভৌত অবকাঠামো ও ভবনসহ প্রায় ১০ কোটি ব্যয় হয়। অথচ জিরো পারসেন্ট পাস। এখন কি করা দরকার?
পক্ষান্তরে, নরসিংদির নাছিমা কাদের মোল্লা হাই স্কুলে ৩২০ জনের মধ্যে সবাই জিপিএ ৫ পেয়েছে। অভিনন্দন। জানাই। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছিলো-
‘জিরো পাস’ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মার্জ বা একত্রীকরণ পরিকল্পনা নেয়ার কথা জানানো হয়েছিলো—যদি দেখা যায় একই ধরণের ব্যর্থতা ধারাবাহিকভাবে হয়, তবে ওই স্কুলগুলো একত্রিত করা হবে । সুপারিশ করা হয়েছিলো অ্যাকাডেমিক অ্যাপ্রুভাল বাতিল করা ও সংশ্লিষ্ট বোর্ড থেকে যত দ্রুত সম্ভব প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া। চারটি প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক অনুমোদন বাতিল করা হয়েছিলো ।
তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী ও ডিএসইর উচ্চ পদাধিকারীরা ‘জিরো পাস’ স্কুলগুলো থেকে ব্যাখ্যা নিয়েছিলেন ও রিপোর্ট চেয়েছিলেন। বিস্তারিত তথ্য, গত পাঁচ বছরের ফলাফল, কারিগরি কারণ, অন্যান্য কারণ। অবশেষে তেমন কিছু হয় নাই।
আমরা চাই বর্ণিত ১৩৪ স্কুলের অ্যাকাডেমিক অ্যাপ্রুভাল বাতিল করা হোক এবং শিক্ষার্থীদের অন্যত্র নিকটস্থ স্কুলে একীভূত করা হোক এবং মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হোক যাতে ভবিষ্যতে এমন গাফিলতি আর না হয়।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ