দেশের চরাঞ্চালের শিক্ষকদের জন্য নতুন করে দুর্গম ভাতা চালু করতে যাচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এছাড়াও দীর্ঘ ১৬ বছর পর আবারও আগের নিয়মে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা চালু হচ্ছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বন্যা, খরা আর নানামুখী সমস্যা নিয়ে চরাঞ্চলে পাঠদান করছেন শিক্ষকরা। বর্ষাকালে নৌকায়, শুকনো মৌসুমে দীর্ঘ বালু পথ পায়ে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতে হয় শিক্ষকদের। এসব নানাবিধ সমস্যা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই ভুক্তভোগী শিক্ষকদের। তাই দুর্গম ভাতা চালু করা হচ্ছে। জুনের মধ্যেই সব কিছু হয়ে যাবে।
এ বছর থেকেই ডিসেম্বরের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি ট্যালেন্টপুল ও সাধারণ দুই ধরনের বৃত্তির অর্থ বাড়ানোর পাশাপাশি বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত দুইটি প্রস্তাব দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বর্তমানে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা মাসে ৩০০ টাকা এবং সাধারণ বৃত্তিপ্রাপ্তরা ২২৫ টাকা করে পায়। নতুন নীতিমালার খসড়ায় উভয় ক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ যৌক্তিক হারে বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮২ হাজার ৫০০ থেকে বাড়িয়ে এক লাখ করার প্রস্তাবও করা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেছন, প্রাথমিকে পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছে। আমরা শিক্ষাথীদের জন্য বৃত্তি এবং দেশের চরঞ্চালের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য দুর্গম ভাতা চালু করতে যাচ্ছি।
জানা গেছে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর প্রথমেই দেশের শিক্ষাখাতে নজর দেন। ব্রিটিশ কলোনিয়াল ব্যবস্থায় এ দেশের মানুষ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। কারিগরি শিক্ষাকে অভিহিত করতেন জনকল্যাণের শিক্ষা হিসেবে। তার দর্শনের মধ্যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও ভাষাগত উৎকর্ষের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল। বিগত ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান রাজধানীতে ‘জাতীয় শিক্ষা কর্মশালা’ আয়োজন করেন। এতে শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত সারাদেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষাকর্মী এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞগণ উপস্থিত ছিলেন। সেই শিক্ষা চিন্তা ও দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দেড় দশক বাংলাদেশে উপরোক্ত উক্তির বাস্তব প্রতিফলন দেখা গেছে। শেখ হাসিনার আমলে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তার ক্ষত সারাতে আগামী কতো যুগ আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কেননা তার আমলেই এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্টের ভেতর দিয়ে গেছে। নতুন কারিকুলাম, পরীক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও অবাধে নকলের সুযোগ, শ্রেণি কাঠামোগত পরিবর্তনের পরীক্ষণ, নতুন ধারার প্রশ্ন পদ্ধতিসহ তিন মেয়াদে এমন সব বেসিক বিষয় নিয়ে তারা কাটাছেঁড়া করেছে যে পুরো জাতি ছিল বিভ্রান্ত। কূল-কিনারাহীন ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থী। আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় কেটেছে অভিভাবকদের জীবন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান বলেন, ১৬ বছর পর আগের নিয়ম ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক পরীক্ষা শেষেই বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে বৃত্তি পরীক্ষার নীতিমালার খসড়া এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি চরাঞ্চলের শিক্ষকদের জন্য দুর্গম ভাতা চালু করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আগের মতো বৃত্তি পরীক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এরপর নীতিমালা চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে। এখন পর্যন্ত প্রতিটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মোট শিক্ষার্থীর ২০ শতাংশকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়ে থাকে। সেটি বাড়ানো হবে।
গত ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে এসে এই পরীক্ষা স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয়। পিইসি পরীক্ষা বন্ধ হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যায় পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবর্তিত প্রাথমিক বৃত্তিও। তবে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে হঠাৎ বৃত্তি পরীক্ষা চালুর ঘোষণা দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ সিদ্ধান্তকে ঘিরে তখন শিক্ষাবিদদের পক্ষ থেকে নানা সমালোচনা ও আপত্তি ওঠে।
বিশেষজ্ঞরা বৃত্তি পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তৎকালীন প্রশাসন তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। ঘোষণার পর ওই বছরই অনুষ্ঠিত হয় প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা। তবে ফল প্রকাশে দেখা দেয় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা। ফলাফল প্রকাশের পর তাতে নানা ভুল ধরা পড়ে, ফলে ফল স্থগিত করতে হয়। পরে সংশোধন করে নতুন করে ফল প্রকাশ করা হয়।
২০২৩ খ্রিষ্টাব্দেও বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমানে আবার নতুন করে বৃত্তি পরীক্ষা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। সর্বশেষ বৃত্তিতে ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী ট্যালেন্টপুল এবং ৪৯ হাজার ৩৮৩ জন সাধারণ বৃত্তি পেয়েছিল। উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডভিত্তিক কোটা পদ্ধতিতে এই বৃত্তি দেওয়া হয়। সর্বশেষ প্রতিটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মোট শিক্ষার্থীর ২০ শতাংশকে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আবারও প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। এ বছর থেকেই এই পরীক্ষা নেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (পরিচালক প্রশাসন) যুগ্মসচিব কামরুল হাসান বলেন, এ বছর বৃত্তি পরীক্ষা চালু হবে, এটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার পাশাপাশি চরাঞ্চলের শিক্ষকদের জন্য দুর্গম ভাতা চালু করা হচ্ছে। জুনের মধ্যেই সব কিছু হয়ে যাবে। বন্যার সময় চরঞ্চালের শিক্ষকরা ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করেন। সেজন্য এটি চালু করা হচ্ছে। এটা শিক্ষা বিস্তারে নতুন উদ্যোগ।