মাছুম বিল্লাহ। ছবি : দৈনিক শিক্ষাডটকম
আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, একটি বড় পদে বদলির জন্য তিনি এক কোটি টাকা ঘুসের প্রস্তাব পেয়েছিলেন।
দুর্নীতির চিত্র এবং দুর্নীতি বন্ধে তার সরকারের অবস্থান তুলে ধরে উদহারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘একটি বড় পদের পদায়নের জন্য আমার কাছে তদবির এসেছিলো। তার জন্য প্রথিতযশা একজন বুদ্ধিজীবী তদবির করেছিলেন। পরে তার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখি তিনি ওই পদের জন্য যোগ্য নন। তখন আমরা তাকে প্রত্যাখ্যান করি।
পরবর্তীতে তিনি অন্য মাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন এবং তিনি আমাকে একটা অ্যামাউন্ট অফার করেন। টাকাও আমি বলে দিই, এক কোটি টাকা অফার করেছিলেন। তিনি যাকে দিয়ে বলেছিলেন, তিনি আমার পরিচিত। যিনি নিজেও একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন। আমি আর বিস্তারিত বলতে চাচ্ছিনা।’
শিক্ষা উপদেষ্টার এই ক’টি লাইনের মধ্যে দিয়ে দেশের দুর্নীতি, বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। এসব দুর্নীতি সম্পর্কে আমরা সবাই জানি কিন্তু দায়িত্বশীল কারুর মুখ থেকে এ ধরনের কথা বিশেষ করে অযোগ্য বলে প্রত্যাখ্যান করা এবং অর্থ না নেয়ার কথা আমরা আগে শুনিনি।
আমরা অবশ্য এও জানি যে, বর্তমানে সরকারে যারা আছেন তারা সৎ, যোগ্য, লোভহীন এবং প্রকৃত দেশদরদী। সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক ছলা-কলা বুঝেনা, তারা বুঝে রাষ্ট্র থেকে তাদের প্রাপ্যটা অর্থপ্রদান ছাড়া ঠিকমতো পেয়েছে কিনা। সেই কাজটি নিশ্চিত করার জন্য এই সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং সেই কথাটিই শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন। সরকার শিক্ষাব্যবস্থা স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করতে জিরো টলারেন্স নীতিতে অবস্থান করছে।
তিনি আরো বলেন, ‘আমি বোঝাতে চাচ্ছি, আমার সহকর্মী যারা আছেন তারা যেনো নৈতিক অবস্থানে স্থির থাকেন। আমি পদে থাকা অবস্থায় কোনো দুর্নীতি সহ্য করবো না। দুর্নীতির কথা আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শুনি। আমার কাছে যে পত্রিকাগুলো আসে, সেগুলো বেশিরভাগ কাটিংয়ে দুর্নীতির খবর থাকে। তবে কোনটা সত্য, কোনটা সত্য নয় তা যাচাই করার সক্ষমতা সব সময় আমাদের হাতে থাকেনা। তবে যেখানে ঘটনা ঘটে, আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট-জিরো টলারেন্স।’ উক্ত সম্মেলনে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব, কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব, ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। দেশের শিক্ষা বিভাগে ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র সম্পর্কে উপরোক্ত কর্মকর্তারাও ভালভাবে অবহিত। এটি সত্য যে, তাদের একক প্রচেষ্টায় হয়তো দুর্নীতিতে ডুবে থাকা শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা যাচ্ছেনা। তবে এটিও সত্য যে, তাদের কঠোর অবস্থান বিষয়টিকে অনেকটাই ভালো পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে।
রাজনৈতিক সরকারের আমলে এ ঘটনা একেবারেই মামুলি ব্যাপার। আমরা যাকে ‘রাজনৈতিক পদ বা পোস্ট’ বলে থাকি। অমুক এতোবড় পজিশনে বসেছেন কারণ তার উক্ত পার্টির সঙ্গে লিংক আছে। ঘটনা আসলে এতোটুকুই না। এরসঙ্গে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন জড়িত থাকে।
আর তাই মন্ত্রী আমলারা,তাদের চারপাশের লোকজন এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন সবারই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়। বাজার করেন সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড আর দুবাইতে। বাড়ি করেন কানাডা, আমেরিকা আর ইংল্যান্ডে! তাদের কালো টাকার দাপটে সমাজে সৎ ও সাধারণ মানুষের টিকে থাকা মুস্কিল।
এসব যখন রাষ্ট্রীয় আনুকুল্যে সংঘটিত হয় তখন রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র থাকেনা, সাধারণ ও সৎ নাগরিকদের দেশে বাস করাটা হয়ে ওঠে জাহান্নামের মতো। এসব ঘটনা ও অবস্থা আমরা এতটা বছর বেদনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি। ক্ষমতার বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল থাকে তারা এগুলো সবকিছু জানেন, তাই ঐসব পদে বসার জন্য ধৈর্য্য ধরতে চাননা কিন্তু মুখে বলেন, জনগণের খেদমতের জন্য তারা এসব করছেন। দেশের জনগণ ও সৎ মানুষেরা এগুলোও জানেন কিন্তু তাদের করার কিছু থাকেনা।
একজন কর্মকর্তাকে যখন অর্থের বিনিময়ে, পার্টি সংশ্লিষ্টতার কারণে কোনো পজিশনে বসানো হয়-- সেখানে কি হয়? বহু সৎ, দক্ষ ও উপযুক্ত কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করে অসৎ, অদক্ষ ও অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে বসানো একটি মারাত্মক অনৈতকি কাজ, বিরাট ধরনের পাপ। এর ফলে, একদিকে যেমন কর্মকর্তাদের মধ্যে বঞ্চনার কালচার সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে ওই বিভাগ তথা রাষ্ট্রের গোটা বিভাগে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
সেটি অধঃস্তনরা প্রকাশ করতে পারেন না বলে ধীরে ধীরে বিভাগের সব স্তরে ক্ষোভ জমতে থাকে। অসততার একটি মারাত্মক নেগেটিভ প্রভাব সর্বত্র পড়তে থাকে। যার ফলে গোট সমাজ বিষিয়ে ওঠে। আর ঐসব অসৎ ও অদক্ষ কর্মকর্তাদের দ্বারা কোনো মানুষের মঙ্গল হয়না, অধীনস্তরা কোনো কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে করতে পারেন না। সৎ ও নীতিবানরা হন কোনঠাসা। গোট সমাজ কলুষিত হতে থাকে। অবশেষে তার বিস্ফোরণটি ঘটে অত্যন্ত বিকট শব্দে।
প্রতিটি মানুষ যদি একবার চিন্তা করে যে, একটি নির্দিষ্ট সময় পরে তাকে এ গ্রহ ছেড়ে যেতে হবে। কোথায় যাবে কেউ জানেনা। এটি কারুরই অবিশ্বাস করার যো নেই। কিন্তু একটি সুন্দর জীবন,একটি সুন্দর অফিস, একটি সুন্দর সমাজ উপহার দেয়ার জন্য একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সবই ছিলো কিন্তু কিছুই করতে পারেননি তিনি। বরং দুর্নীতি আর অসততায় ডুবিয়েছেন পুরো বিভাগ, কলুষিত করেছেন পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা। কি লাভ এসব অবৈধ টাকা লেনদেন করে? কেউ আমরা সেটি চিন্তা করিনা।
ঢাকার কিছু ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পুলিশের পাশাপাশি দেখা যায় আনসার সদস্যরাও ডিউটি করেন। পরিচিত অনেক বলেছেন যে, ঐ আনসার সদস্যটিকে দেখছেন না এখানে কযেকমাস যাবৎ। এখানে ডিউটি পেতে তাকে কয়েক জায়গায় মোটা অঙ্কের ঘুসও দিতে হয়েছে। তার ডিউটি পেতেও ঘুস দিতে হয় কারণ সেখানে টু-পাইস কামানো যায় বামহাতে। এই তো আমার রাষ্ট্র। আর ঐ ট্রাফিক পুলিশ, সার্জেন্ট যারা একটি নির্দিষ্ট থানার অধীনে ডিউটি করেন তাদের যে পরিমাণ অর্থ দিতে হয় তার চিন্তা করতে পারবেন না!’ বিষয়টি আমি জানি তারপরও অবাক হতে হয়।
একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই শুনেছি যে, ম্যাজিস্ট্রেটকে ভাল পোস্টিং নিতে হলে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রায়ই পুলিশ ধরে নিয়ে যায় আবার ক’দিন পরে অমুক আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম জীবেন বুঝিনি, পরে জেনেছি এর পেছনে শুধু অর্থ। জামনি টামিন কিছু না। এগুলো পুলিশে এবং অন্যান্য বিভাগে নিয়মিত ও চিরাচরিতভাবে করা হয়। সমাজের সবাই জানে। তাই আইনকে কেউ শ্রদ্ধা করতে চায়না আমাদের মতো দেশে।
কিন্তু যে বিভাগটি মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবে পরিচিত সেই বিভাগও যতি এতো কলুষিত হয় তাহলে মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বন্ধুদের অনেকেই গত সরকারের আমলে সরকারের শিক্ষা বিভাগের বড় বড় পজিশনে ছিলেন,আছেন। শুনে ও দেখে খুব ভাল লাগে, মন আনন্দে আর গৌরবে ভরে যায় কিন্তু যখন খবর আসা শুরু হলো যে, শিক্ষা বিভাগের কোন পজিশন বাগাতে কত টাকা, কোন পোস্টিংয়ের জন্য কত টাকা রেট তখন সমস্ত আনন্দ উবে যায়। কারণ তাদের দেখলেই মনে হয়, কত টাকা দিয়ে ঐ পদ বাগানো হয়েছে। একই খেলা সর্বত্র!
বর্তমানে দেশে বিশেষ ধরনের সরকার আছে বলে এ ধরনের ঘটনা কম হচ্ছে বা হতে পারছে না আগের মতো এতো সহজে। কারণ এই সরকার যারা পরিচালনা করছেন, তারা কেউই অর্থের জন্য কিংবা প্রতিপত্তির জন্য সরকারে আছেন এমন নয়। কিন্তু তাদের তো থাকতে দেয়া হচ্ছেনা। সাধারণ মানুষ ভাবছে কতো টাকায় শিক্ষা বিভাগসহ দেশের অন্যান্য পজিশনগুলো আবার বিক্রি হওয়া শুরু হবে! জনগণকে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড আর দুর্নীতি দেখতে হবে। নিজেদের বৈধ পাওনাটাকে রাষ্ট্র থেকে অতিরিক্ত ও অবৈধ অর্থ দিয়ে আদায় করতে হবে। দেশে যদি এমন ঘটনা আর না ঘটতো! সেই দিন কি আমরা আবার দেখতে পাবো?
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক