শিক্ষকরা ডিজির সম্মান রক্ষা না করলে প্রশাসন ক্যাডার বসে পড়বে | শিক্ষাবিদের কলাম নিউজ

শিক্ষকরা ডিজির সম্মান রক্ষা না করলে প্রশাসন ক্যাডার বসে পড়বে

আমার মনে আছে শিক্ষাসচিব মোহাম্মদ শহীদুল আলম রাজউক কলেজের এক অনুষ্ঠানে ( ঐ কলেজে আমি তখন ওখানকার শিক্ষক, শিক্ষাসচিব কলেজটির চেয়ারম্যান) বলেছিলেন ‘একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পড়াবেন, তিনি ডিরেক্টর ও ডিজি হতে যাবেন কেন? আমরা চেষ্টা করছি মাউশি অধিদপ্তরের যতগুলো পরিচালকের পদ আছে সেগুলোতে এবং মহাপরিচালকের পদটিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বসবেন। আমরা এ ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ আমলাদের এই এক অবাক করা বিষয়, তারা মনে করেন আমলাদের সব জায়গায় থাকতে হবে, তারা না হলে কোনো ধরনের প্রশাসনই চলবে না।

#মাউশি #শিক্ষা ক্যাডার #এমপিও

দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার অভিভাবক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। এই পদটি যত বড় তত অসহায়! এই পদের অসহায়ত্বের কথা আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে প্রত্যক্ষ করি, জানি এবং শুনে থাকি। দেশের শিক্ষাবিষয়ক একমাত্র প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তা ও শিক্ষাবিষয়ক ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম মহাপরিচালকের অসহায়ত্বের কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছে সম্প্রতি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাদে দেশের সার্বিক শিক্ষার সর্বোচ্চ পদ, এটি অলংকৃত করেন একজন অধ্যাপক।

এটি এই পদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আর তাই শিক্ষা বিভাগের দুই সচিবকে শিক্ষার সর্বোচ্চ পদ না বলে সাধারণভাবে আমরা এই পদটিকেই বুঝি। শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদ হওয়ার সুবাদে পদটির প্রতি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি পড়ে আছে বহু আগে থেকেই। আমার মনে আছে শিক্ষাসচিব মোহাম্মদ শহীদুল আলম রাজউক কলেজের এক অনুষ্ঠানে ( ঐ কলেজে আমি তখন ওখানকার শিক্ষক, শিক্ষাসচিব কলেজটির চেয়ারম্যান) বলেছিলেন ‘একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পড়াবেন, তিনি ডিরেক্টর ও ডিজি হতে যাবেন কেন? আমরা চেষ্টা করছি মাউশি অধিদপ্তরের যতগুলো পরিচালকের পদ আছে সেগুলোতে এবং মহাপরিচালকের পদটিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বসবেন। আমরা এ ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ আমলাদের এই এক অবাক করা বিষয়, তারা মনে করেন আমলাদের সব জায়গায় থাকতে হবে, তারা না হলে কোনো ধরনের প্রশাসনই চলবে না।

কিন্তু শিক্ষা প্রশাসন যে একটি আলাদা বিষয় সেটি তারা ভাবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা ভিসি হন তারা সবাই শিক্ষক, সেখানে অতিরিক্ত সচিব বসেন না কিন্তু মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি পদে প্রশাসন ক্যাডারের অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কাউকে বসিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন কেন? এখনও কেউ কেউ আছেন বিষয়টি চাচ্ছেন। বিভিন্ন পক্ষ থেকে এর বিরোধিতা এসেছে, আমি নিজেও বাংলা ও ইংরেজিতে বেশ কিছু আর্টিকেল লিখেছিলাম যে, ঐ পদটি শিক্ষকদের এখানে শিক্ষকদেরকেই বসাতে হবে। বিষয়টি টিকে গেছে কিন্তু পদটির অবস্থান আর শক্ত হয়নি, পদটি নামে অনেক বড় কিন্তু দুর্বলই রয়ে গেছে!

এই পদটিতে বসানোর জন্য কোনো নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় ডিজি পদায়নের ফলে এর পদটির গুরুত্ব অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। মন্ত্রণালয় তো বিষয়টি অবলোকন করতে থাকে, তারা তাদের কর্তৃত্ব তখন আরো বেশি ফলানোর চেষ্টা করে। আর করবে নাই বা কেন? এ ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনায় ডিজি পদ বাগানো হলে তিনি তো যা ইচ্ছে তাই করবেন, তাই মন্ত্রণালয়ের কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, তাতে ব্যালান্স রক্ষা করা যায়।

বর্তমান সরকার এই পদে নিয়োগের একটি ক্রাইটেরিয়া করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কারণ এতোবড় পদে স্বামী, মামা, খালু, খালাম্মা আর বড়ভাই ধরে এই পদ অলংকৃত করার মানে হচ্ছে পুরো শিক্ষা বিভাগের ওপর চুনকালি দেওয়া। এসব করে করে দিনে দিনে পদটি একেবারে মামুলি হয়ে গেছে। বর্তমানে ড. মুহাম্মদ আজাদ খান মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, তিনি ১৪শ বিসিএস এর কর্মকর্তা। ২০ ফেব্রুয়ারি ঐ পদে বসেছেন। এর আগে সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। দৈনিক আমাদের বার্তার বর্ণনা অনুযায়ী তার অফিস কক্ষের দরজায় লাথি মারেন প্রদর্শক পদে নিয়োগ প্রত্যাশীরা। কিন্তু মহাপরিচালককে রক্ষায় শিক্ষা ভবনের ওসি-খ্যাত উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক কেউ এগিয়ে আসেননি। এই পদটি শুধু একটি চেয়ার নয়, একজন সম্মানিত শিক্ষকের চেয়ার, শিক্ষকের পদ যেটি আমলারা বহু চেষ্টা করেও এখনও নিতে পারেনি। সেনা অফিসারদেরও এখানে পদায়ন করা হয়েছিলো, সেটিও কিন্তু টিকে নাই।

কাজেই সব শিক্ষককে এই পদকে সম্মান জানাতে হবে, এই পদের সম্মান রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে। ডিজির দরজায় কারা লাথি মেরেছেন অথচ সেখানে প্রোস্টেস্ট করতে কোনো কর্মকর্তা আসেন নি, এটি কিসের লক্ষণ? তারা কি স্বগোত্রীয় শিক্ষকের মানহানির বিষয়টি তাহলে উপভোগ করেছেন? এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক। আপনারা কি উপভোগ করলেন? আপনারা যারা যে পদে আছেন, এমনকি দু একজন যদি ঐ পদে বসতে পারেন তাদেরও তো একই দশা হবে।

আপনারা যদি পদটির সম্মান রক্ষা না করেন তাহলে তো প্রশাসন ক্যাডার থেকে একজন অতিরিক্ত সচিব এসে আপনাদের (শিক্ষক ও অশিক্ষক) সবার ওপরই ছড়ি ঘোড়াবেন তখন কেমন হবে? আমরা বিভিন্ন কলেজে সেনা অফিসারদের অধ্যক্ষ হিসেবে দেখতে পাচ্ছি, তারাও যদি কেউ এসে বসেন সেটিও খুব অবাক করা বিষয় হবেনা। এ ধরনের কিছু ঘটলে পুরো শিক্ষা ক্যাডার দায়ী থাকবেন। ডিজির দরজায় যারা লাথি মেরেছেন তারা সরকারি কলেজে প্রদর্শক পদে চাকরির ফল প্রত্যাশী। চাকরি হলে পদোন্নতি পেয়ে তারাও হয়তো একদিন কলেজের অধ্যাপক হবেন, শিক্ষা প্রশাসনে চেয়ারম্যান, পরিচালক হবেন।

জানা যায়, গত মাসে মহাপরিচালক অফিসে এসেছেন, কখনো রিকসায়, কখনো পায়ে হেঁটে আবার কখনও মেট্রোরেলে কারণ তার জন্য সরকারি বরাদ্দের গাড়িতে তেল-গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে রেখেছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের জুনিয়র সহকর্মী ডেপুটি ডিরেক্টর। তিনি তার ক্ষমতা দেখিয়েছেন, হয়তো বন্ধুবান্ধব কিংবা স্ত্রীর কাছে গল্পও করেছেন যে তিনি ডিজিকে গাড়ি দেননি, তাকে হাঁটিয়েছেন! এটি শুধু বেয়াদবি নয়, অন্যায় এবং চেইন অব কমান্ড পুরোপুরি দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। এটি কারুর জন্যই মঙ্গলজনক নয়।

মন্ত্রণালয়ের তালিকার বাইরে থাকা বেসরকারি বিএড কলেজ থেকে সনদ নেয়া কয়েকজন স্কুল শিক্ষক বিএড কলেজের মালিক জনৈক নজরুলের নেতৃত্বে মহাপরিচালকের কক্ষের সামনে হইচই করেছেন। ইউটিউবার ও ফেসবুকার ভাড়া করে নিয়ে এসে মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে লাইভ অপপ্রচার করেছেন অনেকক্ষণ। পরে শিক্ষা ভবনের নীচতলার ক্যাস্পাসে মানববন্ধও করেছেন তারা। তাদের দাবি বিএড স্কেল পাওয়া। মন্ত্রণালয় তাদেরকে স্কেল দিতে না করেছে।

মন্ত্রণালয় ঠিকই করেছে। এর নেপথ্যে রয়েছে অধিদপ্তরের কতিপয় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, যারা নিজেরাও এসব বিএড এমএড কলেজ থকে সনদ নিয়েছে গত কয়েক বছরে। এসব সনদ দিয়ে তারা পদোন্নতি নিয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হওয়ার সব আয়োজন চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। মহাপরিচালককে না জানিয়েই জ্যেষ্ঠতার তালিকা তৈরি ও অন্যান্য তথ্য আহ্বান করা হয়েছে একাধিকবার। এটি কিভাবে সম্ভব? তারমানে ডিজিকে তারা ধর্তব্যের মধ্যেই রাখেননি, ডিজি পদ তো এমনটি হবেনা। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এসব বিষয় কথা বলতে হবে।

জানা যায়, মহাপরিচালকের মাসিক সভায় কখনো যোগদান করেন না একজন পরিচালক। এটা তো ডিজিসহ পুরো শিক্ষা প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গলি প্রদর্শন করার মতো! এ ধরনের লোকজন যখন দায়িত্বশীল পদে বসবেন তখন পুরো অধিদপ্তর আরো কলুষিত করবেন।

কাজেই, মন্ত্রণালয় থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নষ্ট রাজনীতির খেলা যাতে শিক্ষা প্রশাসনে আর না হয় সেজন্য বর্তমান সরকারকে কাজটি শুরু করে যেতে হবে। এ ধরনের তেলের ঘটি আর হাতে ছড়ি নিয়ে কেউ পরিচালক বা শিক্ষা প্রশাসনের কোথাও গিয়ে বসে শিক্ষার পরিবেশকে যাতে কলুষিত না করতে পারে, রাজনৈতিক সরকার আসার আগেই কাজটি করতে হবে যা উদাহরণ হয়ে থাকবে। পরে এর লাগাম টাকা আরো কঠিন হবে।

মাউশি অধিদপ্তরের মাদরাসা শাখা হিসেবে পরিচিত বিশেষ শাখাটার এক সময় কাজ ছিলো কারিগরি ও মাদরাসার এমপিও ও অন্যান্য বিষয়াদি দেখা। কিন্তু মাদরাসা ও কারিগরি অধিদপ্তর আলাদা হওয়ার পর ঐ শাখার কোনো কাজ নেই। তবে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরেও ঐ জায়গাটির যেমন পরিবর্তন হয়নি তেমনি মহাপরিচালকও সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠ করতে পারেননি।

এভাবে মহাপরিচালকের অসহায়ত্বের কথা ও উদাহরণ প্রায়ই উঠে আসে বিভিন্ন আলোচনায়। কিন্তু আমরা পদটিকে সঠিক মর্যাদার স্থানে দেখতে চাই সেটি করার জন্য শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের যেমন প্রচেষ্টা থাকতে হবে, এই পদে যারা বসেন তাদেরও পদটির সম্মান, ওজন ও মাহাত্ম্য ধরে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সব হাল ছেড়ে দিলে হবেনা।

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক

#মাউশি #শিক্ষা ক্যাডার #এমপিও