দত্তবাড়ির বিখ্যাত ছেলেটি | মতামত নিউজ

দত্তবাড়ির বিখ্যাত ছেলেটি

ছেলে ইংরেজি ভাষাটা রপ্ত করলেন বেশ ভালোভাবে। তবে শেষমেষ আর উকিল হওয়া উঠেনি তার। ইংরেজি শিখে ছেলে বিখ্যাত ইংরেজি সাহিত্যের কবি হওয়ার চেষ্টা করলেন।

বাবা ছিলেন উকিল। ছেলেকেও চেয়েছিলেন উকিল বানাতে। তখন ইংরেজি ভাষা জানাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। পাকা উকিল হতে গেলে ইংরেজি ভাষা জানাটা তখন রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিলো। তাই ছেলেকে নিয়ে পাড়ি দিলেন কলকাতায়।

ছেলে ইংরেজি ভাষাটা রপ্ত করলেন বেশ ভালোভাবে। তবে শেষমেষ আর উকিল হওয়া উঠেনি তার। ইংরেজি শিখে ছেলে বিখ্যাত ইংরেজি সাহিত্যের কবি হওয়ার চেষ্টা করলেন। সেই ছেলেটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পরে হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মহাকবি।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ও মাতা জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। বাবা ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের এক খ্যাতনামা উকিল। মধুসূদনের প্রাথমিক পাঠ শুরু হয় তার মা জাহ্নবী দেবীর কাছে। মা জাহ্নবী দেবীই ছিলেন মাইকেলের প্রথম শিক্ষক।

ছোটবেলা থেকেই জাহ্নবী দেবীই মাইকেলকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত করে তোলেন। স্থানীয় শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। ইমাম সাহেব তার মধ্যে ধীরে ধীরে বাংলা, ফারসি ও আরবি ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। যশোরের কপোতাক্ষ নদীর পাড়েই বাল্যকাল অতিবাহিত হতে থাকে মাইকেলের।

\মধুসূদনের যখন সাত বছর বয়স, সেই সময় থেকেই তাকে পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় পাড়ি জমাতে হয়। কলকাতায় গিয়ে খিদিরপুর স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তদনীন্তন হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা শিখে ফেলেন। মেধাবী ছাত্র হওয়ায় তিনি কলেজের অধ্যক্ষের নজরে আসেন। জানা যায়, হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষই মধুসূদনের মনে কাব্যপ্রীতি সঞ্চার করেছিলেন।

এছাড়া হিন্দু কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ডিরোজিওর স্বদেশানুরাগের স্মৃতিও তাকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করতো। হিন্দু কলেজে পড়ার সময় মাইকেল মধুসূদনের সঙ্গে যেসব সহপাঠীরা পড়তেন তারাও কবির মতো পরে হয়েছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এদের মধ্যে ছিলেন ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ। মাইকেলের জীবনে মস্তবড় একটা পরিবর্তন দেখা দেয় ইংরেজি ভাষা রপ্ত করার পর। উকিল হওয়ার জন্য মাইকেলের বাবা ছেলেকে ইংরেজি ভাষা শেখালেও আঠারো বছর বয়সেই মহাকবি হওয়া ও বিলাতে যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়।

হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের সময়ে মধুসূদন প্রথম কাব্য চর্চা শুরু করেন। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং ওল্ড মিশন চার্চ নামে এক অ্যাংলিক্যান চার্চে গিয়ে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। পাদ্রী ডিলট্রি তাকে ‘মাইকেল’ নামকরণ করেন। মধুসূদন পরিচিত হন ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ নামে।

কবির এই ধর্মান্তর সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। এ ঘটনায় রাজনারায়ণ দত্ত তার বিধর্মী পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের পরও মধুসূদন শিবপুরের বিশপস কলেজে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। পিতামাতার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে মাইকেলের।

ছয় হাজার মাইল দূরে অবস্থান করলেও সাগড়দাঁড়ির গ্রামবাংলার নিসর্গ ভোলেননি তিনি। ছোটবেলা থেকেই তার অস্তিত্বের সাথে মিশে ছিলো গ্রামীণ প্রকৃতি। তাইতো দূরে বসেও অন্তরের টানে লিখেছেন বিখ্যাত কবিতা ‘কপোতাক্ষ নদ’। ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি অচিরেই তার মোহভঙ্গ হয়। অতঃপর বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় দু’হাত ভরে লিখতে থাকেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি হিসেবেও অভিহিত করা হয় তাকে। তিনি বাংলা সনেটের জনক। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি মাইকেল একজন সফল নাট্যকার ও প্রহসন রচয়িতাও।

জীবনের দ্বিতীয় পর্বে মধুসূদন নিজ মাতৃভাষার প্রতি মনোযোগ দেন। এ পর্বে তিনি বাংলা সাহিত্যের সব শাখায় কাব্য রচনায় উৎসাহী হন। মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য তার বিখ্যাত রচনা। শিশুদের জন্য তার রয়েছে ‘হেক্টর বধ’ গল্পগ্রন্থ। জীবনের ক্ষণে ক্ষণে নাটক আর আনন্দ-বেদনার মধ্য দিয়ে মধুসূদনের লেখালেখির জগত বহমান ছিলো। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন কলকাতায় এই মহাকবির মৃত্যু হয়।

লেখক: শিক্ষক