অষ্টাদশ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অকৃতকার্য প্রার্থীরা গত রোববার এনটিআরসিএ কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তারা বিভিন্ন ধরনের শ্লোগান দিতে থাকেন। যেমন—’ লিখিত পাস, ভাইভা ফাঁদ মেধাবী কেন গেল বাদ’ লাল সবুজের বাংলায় , বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ চাকরি চাইনা সনদ দে, মেধাবীদের স্বীকৃতি দে’।
৩১মে ১৮তম নিবন্ধন পরীক্ষার মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়। এরপর চুড়ান্ত উত্তীর্ণদের ফল প্রকাশ করা হয় ৪ জুন। এতে অকৃতকার্য হন ২০ হাজারের বেশি, পাস করেন ৬০ হাজারের বেশি। পাসের হার ৭০ শতাংশ। ফল প্রকাশের পর পরই অকৃতকার্য প্রার্থীরা দাবি করে আসছেন যে, তাদের ইচছাকৃতভাবে মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করানো হয়েছে।
লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা-দুটো আলাদা বিষয়। আমাদের লিখিত পরীক্ষায় সৃজনশীল অর্থাৎ প্রার্থীর নিজস্ব মতামত প্রকাশের তেমন কিছু থাকেনা, অধিকাংশই থাকে জ্ঞানমূলক প্রশ্ন অর্থাৎ মুখস্থবিদ্যা। সেখানে অনেকেই নম্বর পেয়ে যান, পাস করেন। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষার বিষয়টি অনেকটাই আলাদা। এখানে অল্প সময়ের মধ্যে প্রার্থীদের আচার-আচরণ, সাইকোলজি, উপস্থাপন দক্ষতা ইত্যাদি অবলোকন করা হয় এবং সেই অনুযায়ী প্রার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়। সেখানে শুধুমাত্র ‘লিখিত পরীক্ষায় নম্বর পেয়েছি, ভাইভায় কেন পাবনা’ বিষয়টি যৌক্তিক নয়।
১৫ জুন আন্দোলনকারীদের একটি দল চারতলায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নূরে আলম সিদ্দিকির সঙ্গে দেখা করেন। সাত সদস্যের প্রতিনিধি দলটি তাদের নিবন্ধন সনদের দাবিতে একটি স্মারকলিপি দেন। তাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছে দাবি করে তারা তাদের ফল পুনঃবিবেচনার দাবি জানান। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তাদের স্মারকলিপি গ্রহণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সচিবের কাছে প্রেরণের আশ্বাস দেন কিন্তু তারা তখনই সমাধান চান।
এটি অবিচেনামূলক কাজ । এতো বড় একটি সিদ্ধান্ত এভাবে নেয়া যায়না যা শিক্ষক হতে ইচ্ছুকদের জানা প্রয়োজন। তাছাড়া মন্ত্রণালয় শুধু ঐ একটি কাজ নিয়ে বসে থাকেনা যে, যেকোনো মুহূর্তে কোনো কিছুর সমাধান দিতে পারবে। তারা ফোন দিতে বলেন ছুটিতে থাকা এনটিআরসিএ চেয়ারম্যানকে ও শিক্ষাসচিবকে।
ঐ সাত সদসের প্রতিনিধিদল ঘন্টাখানেক পরে যখন রাস্তায় চলে আসেন তখন বিক্ষোভরত বাকী প্রার্থীরা তাদের সন্দেহ করেন যে, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের রফা-দফা হয়ে গেছে এবং তাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও এক পর্যায়ে একে অপরকে আক্রমণ শুরু করে দেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এটি শিক্ষকদের জন্য আর একটি অবমাননাকর বিষয়। যারা শিক্ষক হবেন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিবেন, জাতির অভিভাবক হবেন তারা যদি নিজের মধ্যে রাস্তায় এভাবে মারামারি শুরু করেন তাহলে বিষয়টি একটি কুৎসিত পর্যায়ে পৌছে গেছে বলা যায়।
এখন আমরা যদি পাবলিক পরীক্ষা যেমন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই প্রতি বছরই একটি বড় শতাংশ শিক্ষার্থী কৃতর্কার্য হন এবং আরেকটি অংশ অকৃতকার্য হন। এখন অকৃতকার্যরা যদি বোর্ডের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং পাস করিয়ে দিতে বলেন তাহলে বিষয়টি কেমন হয়? সবই কি আমাদের পেশিশক্তির মাধ্যমে অর্জন করতে হবে?
দুপুর দেড়টার দিকে আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দেন যে, এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ যদি তাদের সঙ্গে আলোচনায় না আসে তাহলে তারা ইস্কাটন গার্ডেন রোড অবরোধ করবেন। তারপরেও না এলে না তারা এনটিআরসিএ কার্যালয়ের দিকে অগ্রসব হবেন। তাদের দাবি হচ্ছে তারা ফেল করেননি, তাদের ফেল করানো হয়েছে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলে তারা প্রতিনিধিদলে সদস্য সংখ্যা দশে উন্নীত করে শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিবের উদ্দেশ্যে সচিবালয়ে ছুটেন কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত জানা যায়নি।
যেকোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য অনেক যোগ্য প্রার্থী পরীক্ষায় বসেন, তাদের সবার কিন্তু চাকরি হয়না যদিও সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং যোগ্যও। মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন কিছু দেখে অনেককে বাদ দেয়া হয়। বিসিএস পরীক্ষায় একটি বিরাট সংখ্যক যোগ্য প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক প্রার্থীকে চাকরি প্রদানের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন সুপারিশ করে। বিশাল অংশের পরীক্ষার্থীই কিন্তু বাদ পড়েন।
এটি ঠিক পাস বা ফেল নয়, ওপর থেকে যোগ্যতমদের বাছাই করে করে যতজন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে চাহিদার ভিত্তিতে নির্বাচন করা যায় সেটি করা হয়, যোগ্য অনেকেই কিন্তু বাদ পড়েন। তারা আবার পরীক্ষা দেন। তারপরও একটি নির্দিষ্ট নম্বর ধরা হয় পাস ফেলের। বিগত সরকারের আমলে এসব ক্ষেত্রে অনেকটা এলোমেলো হয়েছে কিন্তু মূল পদ্ধতি একই ছিলো। তাই বলে যেসব প্রার্থীদের সুপারিশ করা হয়নি তারা কি পিএসসি সামনের রাস্তা অবরোধ করবেন? পিএসসি ঘেরাও করবেন? তাহলে তো সমাজে আইন-শৃংখলা বলে কিছুই থাকলো না!
আমাদের সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং সেটির শুরু নিজে, নিজের পরিবার, তারপরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা পড়াবেন তারা হবেন মডেল যাদের দেখে শিক্ষার্থীরা ও সমাজ শিখবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা ও সমাজ এসব কোথায় শিখবেন? অকৃতকার্য প্রার্থীদের অনুরোধ করছি ‘ফেইলার ইজ দি পিলার অব সাকসেস’ কথাটি মনে করার জন্য। আপনার নির্বাচত হননি বলে পচে যাননি। আরো অনেক কিছ করার আছে জীবনে। আপনাদের কাছ থেকে দেশ সমাজ গঠনমূলক ও যৌক্তিক আচরণ দাবি করে।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক