প্রতীকী ছবি
রাষ্ট্র ধ্বংসের অনেক পথ আছে। তবে সবচেয়ে দ্রুত ও কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া। যখন শিক্ষক নয়, বরং শিক্ষার্থীই হয়ে ওঠেন নিয়ন্তা, তখন সেই সমাজের ভবিষ্যৎ যে কোন গন্তব্যে এগোচ্ছে—তা অনুমান করতে আরো কিছু দশক সময় লাগবে।
একজন মেধাবী সদাচারী উপাচার্য কিংবা অধ্যক্ষ যদি দায়িত্বে আসেন, তিনিও টিকতে পারেন না। তিনি ফেরেশতার মতো নিরপেক্ষ হলেও অসহায় হয়ে পড়েন। কারণ, শিক্ষাঙ্গনে ফেরেশতা ও শয়তানের চরিত্র আজ সমানুপাতিক হারে অবস্থান করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আজ আর কোনো মহৎ উদ্দেশে মিছিল গড়ে ওঠে না, বরং যখন স্বার্থে আঘাত লাগে তখনই প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শিক্ষার্থী যখন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে পার পেয়ে যান, তখন সেটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি ভয়াবহ সামাজিক বার্তা।
এই অনিয়মের লাগাম টানতেই হবে। রাষ্ট্রকে এখানে আরো কঠোর হতে হবে। সারাবছর পাঠ্যবই ফেলে আন্দোলনমুখী হয়ে থাকা একটি জাতির জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। শিক্ষার্থীরা যা কিছু দাবি করছেন, তার বড় একটি অংশ বিশ্বের কোথাও বাস্তবায়নযোগ্য নয়। উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থায় কল্যাণের বণ্টন হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে। তবে আমাদের দেশে একটি ক্ষুদ্র অংশের চাপ এবং উৎপাতে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় স্থবির। ছাত্ররাজনীতি এক সময় ছিলো আদর্শভিত্তিক, এখন তা রূপ নিয়েছে দলীয় স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ারে। একসময় সহমর্মিতায় গড়ে ওঠা ছাত্রসংগঠনগুলো আজ মুখোমুখি ঘৃণার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। রাজনীতি শিক্ষায় প্রবেশ করেছে, কিন্তু শিক্ষার সংযম রাজনীতিতে প্রবেশ করতে পারেনি। যার ফল, কিছু ঘটলেই উপাচার্য বা অধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা, প্রশাসনিক ভবন দখল করা। এসব রাষ্ট্রের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সর্বশেষ ঘটনার পর দেখা যাচ্ছে, কিছু ছাত্রদের হাতে ক্যাম্পাস ও হল পরিণত হচ্ছে বিশৃঙ্খলার ঘাঁটি হিসেবে। ডাইনিংয়ের খাবার ভালো না হওয়ায় পদত্যাগ দাবি, কিংবা ‘পছন্দের’ কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় বিক্ষোভ—এসবের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নিলে সুশাসনের আশা করাই বৃথা। মাদকের ব্যবহার, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগত কোন্দল—এসবের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সুশৃঙ্খল না রাখলে প্রজন্ম হয়ে উঠবে বেয়াদব, দায়িত্বজ্ঞানহীন ও রাষ্ট্রবিরোধী। মন্দের সংখ্যা হয়তো এখনো কম, কিন্তু তাদের দাপটে ভালোরা কোণঠাসা। শিক্ষার্থীদের উচিত পড়াশোনাকেই একমাত্র দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করা। আজকের ছাত্ররাজনীতি রাষ্ট্রকে কোনো সুফল না দিয়ে বরং লাশের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। যারা এটি মূল রাজনীতির ধ্বংসাত্মক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তারা সমাজের প্রতিপালক নয়—বরং ধ্বংসের দূত।
শিক্ষা আর শিষ্টাচার যদি একসঙ্গে চলতে না পারে, তবে উন্নয়নের সব অগ্রগতি অর্থহীন হয়ে পড়ে। এখনই সময় দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়ার—অন্যথায় সব অর্জন হারিয়ে যাবে নৈরাজ্যের গহ্বরে।
লেখক: শিক্ষক