শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব | মতামত নিউজ

শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব

শিক্ষার মান নিয়ে যখন চারদিকে হৈ চৈ, হাহাকার এবং গভীর উদ্বেগ, তখনো মন্দের ভালো হিসেবে বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে হলেও অগ্রসর হচ্ছিল। এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিনের অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির বেড়াজাল ভেঙে একটি অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ ও মেধাবান্ধব নিয়োগ পদ্ধতির ইঙ্গিত দিচ্ছিল। কিন্তু সম্প্রতি দৈনিক শিক্ষার একটি রিপোর্ট থেকে জানা গেল, এই আশার আলোতেও তাইরে নাইরে করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

শিক্ষার মান নিয়ে যখন চারদিকে হৈ চৈ, হাহাকার এবং গভীর উদ্বেগ, তখনো মন্দের ভালো হিসেবে বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে হলেও অগ্রসর হচ্ছিল। এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিনের অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি দুর্নীতির বেড়াজাল ভেঙে একটি অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ মেধাবান্ধব নিয়োগ পদ্ধতির ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

কিন্তু সম্প্রতি দৈনিক শিক্ষার একটি রিপোর্ট থেকে জানা গেল, এই আশার আলোতেও তাইরে নাইরে করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, হামলা আর মামলার পর নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি শেষ করতে কর্তৃপক্ষ শর্টকাট পদ্ধতির আশ্রয় নিতে চাইছে। এই উদ্যোগ একদিকে যেমন হতাশাজনক, তেমনই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত।

আমাদের দেশে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু বিচ্যুতি ঘটেছে। যা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে শিক্ষাকে কি সেই তলানির স্তরেই রেখে দিতে চান নীতিনির্ধারকেরা? একটি জাতির মেরুদণ্ড হলো তার শিক্ষা ব্যবস্থা। আর সেই ব্যবস্থার চালিকাশক্তি হলেন শিক্ষকেরা।

যদি দেশের শিক্ষক সমাজই সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন না হন, তাহলে একটি জ্ঞানভিত্তিক, প্রগতিশীল এবং উন্নত প্রজন্ম কীভাবে গড়ে উঠবে? শুধুমাত্র এমসিকিউ পরীক্ষা আর মৌখিক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের সেই পুরনো পথে হাঁটা কি আদৌ কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে? এই প্রশ্ন আজ জাতির বিবেককে নাড়া দিচ্ছে কি না আমি বুঝতে পারছি না?

দেশের কল্যাণের জন্য যদি অতি দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়ার সমাপ্তি এতই আমলাদের পছন্দের ও জরুরি হয়, তাহলে পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে (পিএসসি) অনুরোধ করা যেত, তারা এমসিকিউ এবং ভাইভার মাধ্যমে কিছু তরুণ উদ্যমী সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগে সহায়তা করতে পারতেন। যাতে দেশের মানুষ আরও দ্রুত সরকারি সেবা পেতে পারত। সরকারি প্রশাসনিক পদে দ্রুত জনবল নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা হয়তো ভিন্ন, যেখানে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাস্তবায়নের জন্য কিছু নির্দিষ্ট দক্ষতার প্রয়োজন হয়।

কিন্তু শিক্ষক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। একজন শিক্ষক কেবল তথ্য সরবরাহকারী নন, তিনি একজন পথপ্রদর্শক, একজন আর্দশ এবং একজন ভবিষ্যৎ নির্মাতা। তাঁর হাতেই একটি শিশুর মনন গঠিত হয়, তাঁর মাধ্যমেই একটি প্রজন্ম জ্ঞান মূল্যবোধের শিক্ষা লাভ করে। তাই শিক্ষক নিয়োগে সামান্যতম ত্রুটি বা আপস শুধু শিক্ষাব্যবস্থাকেই ধ্বংস করবে না, বরং পুরো জাতির ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দেবে। এটি এমন একটি বিষয়, যেখানে দীর্ঘমেয়াদী সুফল পেতে হলে স্বল্পমেয়াদী সুবিধার লোভ ত্যাগ করতে হবে।

এখনও শিক্ষা ব্যবস্থার সামান্য কিছু সম্মান অবশিষ্ট আছে। হয়তো পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। তবে সেই সামান্য অংশকে আঁকড়ে ধরে টেনে তুলতে প্রয়োজন মেধাবী দক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকা। তাঁদের বাছাই করতে একটু সময় লাগলেও তা ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য। নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় যে একেবারে নিখুঁত কিছু হচ্ছে, এমন দাবি আমি করছি না। শতভাগ ত্রুটিমুক্ত কোনো প্রক্রিয়া পৃথিবীতে নেই।

তবে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন যে এসেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্ততপক্ষে একটি ন্যূনতম যোগ্যতা নিশ্চিত না করে এখন আর কোনো ব্যক্তি শিক্ষক হতে পারছেন না। যতই তাঁর প্রভাবশালী আত্মীয় বা সুপারিশ থাকুক না কেন। এই ন্যূনতম যোগ্যতা নিশ্চিতকরণই ছিল নিবন্ধন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় অর্জন। এটি একদিকে যেমন যোগ্য প্রার্থীদের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করেছে, তেমনই অযোগ্যদের অনৈতিক পথে শিক্ষক হওয়ার পথ বন্ধ করেছে।

অতএব, আমলাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, তথাকথিতকুইকপদ্ধতি এখানে প্রয়োগ না করে নিজেদের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ দিন। যদি আপনারা সত্যিই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি চান, তাহলে নিজেদের সন্তানদের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান। নিজেদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারি হাসপাতালের শরণাপন্ন হোন। দেখবেন, নিজেদের প্রয়োজনে হলেও আপনারা সেগুলোর মান উন্নয়নে কিছুটা হলেও সচেষ্ট হবেন।

এই সরাসরি অভিজ্ঞতা আপনাদেরকে দেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যাগুলো বুঝতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি নীতি নির্ধারণে আরও সংবেদনশীল করে তুলবে। মনে রাখবেন, দেশের মালিক জনগণ। তাঁরা কোথায় তাঁদের সন্তানদের পড়ালেখা করান আর চিকিৎসা নেন, আর আপনারা কোথায় বিলাসবহুল জীবন যাপন করেনএই বৈষম্য কি কখনও ভেবে দেখেছেন? এই দ্বৈত জীবনযাপন এবং নীতি-নির্ধারণের মধ্যে যে ফারাক, তা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা।

আপনারা প্রায়শই নীতিবাক্য আওড়ান, সুশাসনের কথা বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে একবারও কি বলতে পারবেন, কতজন সরকারি কর্মকর্তা সাহস করে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলেন? কতজন নিজেদের অফিসের সামনে দুর্নীতি দমন কমিশনের সেই বিখ্যাত স্লোগান – ‘আমি আমার অফিস দুর্নীতি মুক্ত’ – লেখার সাহস রেখেছেন? সারাদেশে হয়তো এক শতাংশও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

হাজারে হয়তো একজন কি দুজন। শত শত সরকারি অফিস, এমনকি সচিবালয়েও এমন দৃশ্য বিরল। তাহলে কীসের ভিত্তিতে আমলাদের এত উচ্চস্বর? কেন তাঁরা এখন নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের মতো একটি অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন, তা আমার বোধগম্য নয়। এই হস্তক্ষেপের পেছনে কি কোনো ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ কাজ করছে? যদি তা না হয়, তবে কেন একটি কার্যকর প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে?

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। প্রকৃত মেধাবী এবং যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচন করা হয় দীর্ঘ কঠোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সেখানে কেবল শিক্ষাগত যোগ্যতাই নয়, শিক্ষাদানের দক্ষতা, মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি এবং নৈতিকতার মতো বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমাদের দেশের মতো মামা-খালু বা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের নজির সেখানে বিরল।

কারণ তাঁরা জানেন, এই শিক্ষকদের হাতেই গড়ে উঠবে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব। একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যোগ্য নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা। যা কেবল একজন যোগ্য শিক্ষকই দিতে পারেন। তাই শিক্ষক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে কোনোভাবেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।

আমাদের দেশের স্কুল-কলেজগুলোর পরিচালনা কমিটির হাতে যখন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা ছিল, তখন কী ধরনের অনিয়ম আর দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে, তা কারো অজানা নয়। সভাপতি একদিকে প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বসে থাকতেন, অন্যদিকে অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষক অন্য প্রার্থীর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করে তাঁকে নিয়োগের স্বপ্ন দেখাতেন।

এই দুইমাতব্বরেরদ্বন্দ্বে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়া বছরের পর বছর বন্ধ থাকত। উভয়েই একাধিক চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতেন, যার ফলে একদিকে যেমন যোগ্য প্রার্থীরা বঞ্চিত হতেন, তেমনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষক সংকটে ভুগতো। এই প্রক্রিয়াটি ছিল সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং মেধা-বিবর্জিত। এই প্রেক্ষাপটে নিবন্ধন প্রক্রিয়া ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা এই ধরনের স্থানীয় পর্যায়ের দুর্নীতিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিল।

অতএব, বর্তমান নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে আমি মন্দের ভালো হিসেবেই দেখি। অন্ততপক্ষে  লাগামছাড়া অনিয়ম দুর্নীতি কিছুটা হলেও কমেছে। একটি ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করতে না পারলে এখন আর শিক্ষক হওয়া যায় না। তা সে যত প্রভাবশালী ব্যক্তির সুপারিশই নিয়ে আসুক না কেন।

এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অন্ততপক্ষে একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড তৈরি হয়েছে, যা শিক্ষকতার মতো একটি মহান পেশার মর্যাদা রক্ষায় কিছুটা হলেও সহায়ক হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার দুর্বলতাগুলো দূর করে এটিকে আরও শক্তিশালী নির্ভুল করা সম্ভব। কিন্তু এটিকে বাতিল করে বা শর্টকাট পদ্ধতির মাধ্যমে এর কার্যকারিতা নষ্ট করে আবার সেই পুরনো অন্ধকার যুগে ফিরে যাওয়া হবে আত্মঘাতী।

আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে একটি দীর্ঘমেয়াদী টেকসই পদক্ষেপ গৃহীত হবে। মেধাবী এবং দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার তাড়াহুড়ো বা শর্টকাট পদ্ধতি অবলম্বন না করে একটি স্বচ্ছ নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবেএটাই জাতির প্রত্যাশা।

কারণ একটি মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থাই একটি উন্নত সমৃদ্ধ জাতি গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই সত্যটি উপলব্ধি করার এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুশিক্ষিত এবং নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের, বিশেষ করে নীতিনির্ধারকদের। এই দায়িত্ব পালনে কোনো প্রকার অবহেলা বা আপস কাম্য নয়।

লেখক: মোঃ আবু সাঈদ, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।