বঞ্চনায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জীবন | মতামত নিউজ

বঞ্চনায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জীবন

প্রসঙ্গত, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাদি ইএফটি (ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার) এর মাধ্যমে প্রদেয় হয়ে আসছে; ফলে তারা মাসের শুরুতেই কোনো বিড়ম্বনা ছাড়াই বেতন-ভাতাদি ভোগ করছেন। কিন্তু বেসরকারি তথা এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এই চিত্রটা ছিলো খুবই অপ্রীতিকর। লক্ষণীয়, এমনিতেই এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকরা সাধারণত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির দ্বারা নানাভাবে নাজেহালের শিকার হন তার ওপর আবার মাসিক বেতন-ভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও তাদেরকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত অথচ সর্বৈব অবেহেলিত কোনো পেশাজীবী গোষ্ঠীর নাম যদি বলা হয় তবে এক বাক্যে উচ্চারিত হবে এমপিওভুক্ত শিক্ষক। বলাবাহুল্য, দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার প্রায় ৯৭ শতাংশই এই বেসরকারি তথা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দিয়ে পরিচালিত হয়। অর্থাৎ, শুধু স্বাক্ষরতা শিক্ষাই নয় উপরন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ও উৎপাদনশীল শিক্ষার প্রায় শতভাগই এই এমপিও তথা বেসরকারি শিক্ষকরা লিড করে থাকেন যাদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ।

উল্লেখ্য, শুধু মানবিক মৌলিক চাহিদা হিসেবেই নয়, উপরন্তু সংবিধিবদ্ধ মৌলিক চাহিদা হিসেবেও শিক্ষা রাষ্টীয় কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা। এর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিভাগ হলো-মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না। তাবৎ রাষ্ট্রযন্ত্রের সিংহভাগ জনবলের শিক্ষা বেসরকারি তথা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতেই প্রসূত। ফলে, দেশ ও জাতির অগ্রগতিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ভূমিকা প্রশ্নাতীতভাবে অপরিসীম।

অথচ রাষ্ট্রের এমন অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও সংখ্যাধিক্য পেশাজীবি গোষ্ঠীর আর্থিক সংশ্লেষণ আজো এমপিওর মাধ্যমে ‘অনুদান’ হিসেবে মেটানো হয়, যা অনেকটা লজ্জাকর বটে। কেনোনা, শিক্ষা রাষ্ট্রের অপরিহার্য ও অতীব সংবেদনশীল বিষয় হওয়া সত্তেও এর চালিকাশক্তি শিক্ষকদের বিশাল এই অংশের অনুদান নির্ভর আর্থিক ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রের মৌলিক মর্যাদাকে নিদারুণভাবে হেয় করে বৈকি। এ জীর্ণ দশা এটাই প্রমাণ করে, রাষ্ট্রের এই বিভাগটি অত্যাবশ্যকীয় তথা মৌলিক খাত হিসেবে কাগজে-কলমে স্বীকৃত হলেও স্বাধীনতার এতা বছরে আজো কার্যক্ষেত্রে তা স্বীকৃত হয়নি।

প্রসঙ্গত, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাদি ইএফটি (ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার) এর মাধ্যমে প্রদেয় হয়ে আসছে; ফলে তারা মাসের শুরুতেই কোনো বিড়ম্বনা ছাড়াই বেতন-ভাতাদি ভোগ করছেন। কিন্তু বেসরকারি তথা এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এই চিত্রটা ছিলো খুবই অপ্রীতিকর। লক্ষণীয়, এমনিতেই এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকরা সাধারণত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির দ্বারা নানাভাবে নাজেহালের শিকার হন তার ওপর আবার মাসিক বেতন-ভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও তাদেরকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

প্রতিমাসে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদির প্রতিবেদন পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির স্বাক্ষর হওয়ার পর তা সংশ্লিষ্ট বণ্টনকারী ব্যাংকে জমা দিতে হয়। সভাপতির অনুমোদন স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে যেয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের গলদঘর্ম ছুটে যায়। পরিচালনা পর্ষদের এহেন কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতার কোপানলে পড়ে মাসিক বেতন-ভাতা পেতে অনেক সময়ই বিলম্ব হয়। পাশাপাশি, সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর ও পরিদপ্তর গুলোর অবহেলা তো আছেই। সব মিলিয়ে এসব শিক্ষকদের প্রতিমাসের বেতন-ভাতাদি পেতে মাসের প্রায় অর্ধেক সময় লেগে যেতো। শিক্ষকদের এহেন বিড়ম্বনা এড়াতে সরকারি চাকরিজীবীদের মতো তাদেরকেও ইএফটির আওতায় আনা হয়েছে।

এ লক্ষ্যে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে পরীক্ষামূলকভাবে ২০৯ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে ইএফটির মাধ্যমে বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করা হয়। পরবর্তীতে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরের বেতন ইএফটিতে দেয়া শুরু হলেও সব শিক্ষককে দেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, হিসেবে অনেক শিক্ষকের নামের বানানসহ কিছু মৌলিক তথ্য-উপাত্ত এমপিও শিট, এনআইডি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অমিল থাকায় এমনটি হয়েছে বলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে। তবে যাদের তথ্যাদি নির্ভুল ছিল এমন ১ লাখ ৮৪ হাজার শিক্ষক ও কর্মচারীকে ডিসেম্বর ২০২৪ এর বেতন ইএফটির মাধ্যমে দেয়া করা হয়েছে। পরবর্তীতে ২য়, তয় ও ৪র্থ ধাপে যথাক্রমে ৬৭ হাজার, ৮৪ হাজার ৭ শত ও ৮ হাজার ২ শত ৩৮ জনকে বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে। ৫ম ধাপে ৮ হাজার ৮৮৭ জনকে অপেক্ষামান রাখা হয়েছে এবং এ মর্মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার আইবাস সফ্টওয়্যার কোডে তা প্রেরণ করা হয়েছে মর্মে গণমাধ্যমে মাউশি নিশ্চিত করেছে।

তবে হতাশার বিষয় হলো, এমপিও শিক্ষক ও কর্মচারীরা জানুয়ারী ২০২৫ এর বেতন-ভাতাদি অদ্যাবধি প্রাপ্য হননি। প্রশ্ন উঠেছে, প্রথম ধাপে প্রাপ্যরা ত্রুটিমুক্ত হওয়ার পরেও কেনো তাদের জানুয়ারি মাসের প্রাপ্যতা এখনো দেয়া হয়নি? কেনোই বা আগে থেকে সবার সব তথ্যাদি সংশোধণ না করে ইএফটি কার্যক্রম চালু করা হলো? কর্তৃপক্ষের নিকট এগুলোর কোনো সদুত্তর নেই। তবে আগের সনাতন পদ্ধতি বহাল রেখে নির্দেশিত সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটের প্রেসক্রাইব ওয়েবপেজের মাধ্যমে যাচিত তথ্য নির্ভুলভাবে সম্পাদনের মধ্য দিয়ে ইএফটি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যেতো বলে শিক্ষকসহ সচেতন মহল মনে করছেন। এটা হলে শিক্ষক ও কর্মচারীদের এমন অসহনীয় বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। তবে এখনো আগের মতো বিল সাবমিশন পদ্ধতিতে বেতন-ভাতা মেটানোর পাশাপাশি ইএফটি সংক্রান্ত যাচিত তথ্য সংশোধন করা যেতে পারে বল অনেকে মনে করছেন।

এতে যেমন শিক্ষকরা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারতেন, একই সঙ্গে ক্লাসে সাবলীলভাবে মনোযোগী হতে পারতেন। সময়মত বেতন না হওয়াতে পরিবার পরিজন নিয়ে তাদের অনেককেই বেশ সংকটের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। এমনিতেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে তারা সবসময়ই বিষন্ন থাকেন, তার ওপর আবার মূল্যস্ফীতির দোর্দণ্ড প্রতাপ তাদের জীবনে নাভিশ্বাস তুলে ছেড়েছে। সর্বোপরি, ইএফটি সংক্রান্ত চলমান পরিস্থিতি তাদের স্বাভাবিক জীবনধারাকে নীরবে সংকটে ঠেলে দিচ্ছে। কেনোনা, এই বেতনই তাদের একমাত্র উপার্জন।

উল্লেখ্য, এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন জাতীয় পে-স্কেলের সঙ্গে সমন্বয় করে দেয়া হলেও আনুষঙ্গিক ভাতাদি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত চাকরিজীবীদের তুলনায় বিস্তর ফারাক। জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুসারে যেখানে সরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীরা বাড়িভাড়া পান মূলবেতনের ৪৫, ৫০ ও ৬০ শতাংশ, সেখানে বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের নামকাওয়াস্তে এক হাজার টাকা দেয়া হয়। সরকারিদের চিকিৎসা ভাতা দেয়া হয় ১ একার ৫০০ টাকা; বেসরকারিদের মাত্র ৫০০ টাকা। প্রধান ধর্মীয় উৎসবভাতা সরকারিরা যেখানে বেসিকের শতভাগ পান সেখানে বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীরা পান বেসিকের মাত্র যথাক্রমে ২৫ ও ৫০ শতাংশ । একই পেশায় একই কারিকুলামের আওতায় পাঠদানরত সরকারি শিক্ষকদের শতভাগ ধর্মীয় উৎসব ভাতা দেয়া হয়, অথচ বেসরকারিদের দেয়া হয় মূল বেতনের মাত্র ২৫ শতাংশ; এ বৈষম্য খুবই দুঃখজনক। বাসস্থান, চিকিৎসা ও উৎসবের মতো মৌলিক খাতগুলোতে বৈষম্যের প্রচলন থাকা কখনই সমীচীন হতে পারে না।এটা শিক্ষকদের মনোসামাজিক চেতনায় যথেষ্ট আঘাত করে যার নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষার ওপর পর্যবসিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে, তাদের মাসিক বেতনের সঙ্গে প্রদেয় এক হাজার টাকা ঘরভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা অত্যন্ত অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য বিষয়। অপরিহার্য ও বাড়তি খরচ মেটাতে বাধ্য হয়ে তাদেরকে ব্যাংক ও বিভিন্ন এনজিওগুলোতে চড়া সুদে ঋণগ্রস্ত হতে হয়। চলমান পরিস্থিতিতে সময়মতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় তারা অনেকেই চক্রবৃদ্ধি সুদের কোপানলে অলরেডি পড়ে গেছেন। এতে তাদের দৈনন্দিন জীবনের উৎকন্ঠা ও বিষন্নতার মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। এর ফলে নেতিবাচক প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্লাসের পাঠ কার্যক্রমের ওপর পড়ছে; ব্যাঘাত ঘটছে শিক্ষাদানে; ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থী সমাজ।

এ পরিস্থিতি বেশি দিন চলতে থাকলে শিক্ষায় অপূরণীয় ক্ষতি সংঘটিত হতে পারে মর্মে সচেতন মহল আশঙ্কা করছে। এমনিতেই শিক্ষায় করোনা মহামারির ক্ষতি আমরা এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেনি। তার ওপর আবার এ রকম পরিস্থিতি শিক্ষার ক্ষতিকে আরো ঘনীভূত করে তুলতে পারে, যা মোটেই কাম্য নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষকতা কোনো কায়িক শ্রমের পেশা নয়; এটি শতভাগই মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তি প্রয়োগের পেশা। সুতরাং, তাদেরকে কারকাখানার শ্রমিকের মতো বিবেচনা বা ধারণা করলে ভুল হবে। তাদের বিষন্নমুক্ত মন ও মননের ওপর শিক্ষার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে। এ বাস্তবতার নিরিখে রাষ্ট্র ও সরকারকে শিক্ষক সংশ্লিষ্ট উল্লিখিত সংবেদনশীল বিষয়ে আরো সচেতন ও যত্নশীল হওয়া সমীচীন। বলাবাহুল্য, একই সমাজে, একই কারিকুলামে, একই পেশায় সরকারি ও বেসরকারি মূলক ‘দ্বৈতনীতির কবলে সৃষ্ট মৌলিক বৈষম্য এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সৃষ্টিশীল মননশীলতাকে নষ্ট করছে। আলটিমেট ক্ষতি শিক্ষার ওপরই পড়ছে। অথচ, সরকার, সুশীল, রাজনীতিক কারোরই এমন সংবেদনশীল সমস্যা সমাধানে মাথা ব্যাথা নেই, যা সত্যিই দুঃখজনক ও হতাশার বটে।

শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড তবে শিক্ষক হলো সেই মেরুদণ্ডের মজ্জা। শিক্ষক সমাজকে অবহেলিত রেখে কোনো সংস্কার ও উন্নয়নই অর্থবহ ও টেকসই হতে পারে না। বর্তমান ও আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে শিক্ষিত, দক্ষ ও সুদক্ষ জনবলের বিকল্প নেই। কার্যত, এরূপ জনবল সৃষ্টির নেপথ্য কারিগর শিক্ষকরাই। সুতরাং, জাতীয় স্বার্থেই শিক্ষকদের বড় অংশ বেসরকারি তথা এমপিও শিক্ষকদের সব সমস্যা দূরীকরণে রাষ্ট্র ও সরকারের অধিকতর মনোযোগী হওয়া উচিৎ বলে মনে করি। অন্যথায় বিশ্বায়নের যাত্রায় আমরা পেছনেই পড়ে রইবো।

লেখক: শিক্ষক