শিক্ষকের সম্মানেই জাতির অগ্রগতি | মতামত নিউজ

শিক্ষকের সম্মানেই জাতির অগ্রগতি

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের রাষ্ট্র বরাবরই শিক্ষকদের স্বার্থ নিয়ে একধরনের স্বার্থপর আচরণ করে এসেছে। যখন দেশের অন্যান্য খাতে বরাদ্দ ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ হয়, তখন শিক্ষা ও শিক্ষকরা প্রায়শই প্রান্তিক চাহিদায় রূপ নেয়। অথচ শিক্ষক যদি হাসিমুখে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করতে পারেন, তার ইতিবাচক প্রভাব শিক্ষার্থীদের মননে, আচরণে এবং শেখার মানসে অবধারিতভাবে প্রতিফলিত হয়। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে, শিক্ষককে অবশ্যই প্রেরণাসম্পন্ন, মর্যাদাবান এবং আর্থিক নিরাপত্তা-সম্পন্ন জীবনে অভ্যস্ত করতে হবে।

#এমপিও #শিক্ষক #উৎসব ভাতা

এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত শিক্ষকরা আসন্ন ঈদুল আজহায় বেতনের ৫০ শতাংশ উৎসবভাতা পাচ্ছেন। এটি হয়তো পুরোপুরি প্রাপ্তির নয়, তবুও দীর্ঘ অবহেলার প্রেক্ষাপটে এটি একটি আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ। যেদিন এটি শতভাগে উন্নীত হবে, সেদিন রাষ্ট্র সত্যিকারের অর্থে শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে পারবে। এখনকার এই আংশিক উৎসবভাতা ঘোষণাকেও রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার প্রাথমিক সূচক হিসেবে অভিনন্দন জানানো যেতেই পারে।

কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের রাষ্ট্র বরাবরই শিক্ষকদের স্বার্থ নিয়ে একধরনের স্বার্থপর আচরণ করে এসেছে। যখন দেশের অন্যান্য খাতে বরাদ্দ ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ হয়, তখন শিক্ষা ও শিক্ষকরা প্রায়শই প্রান্তিক চাহিদায় রূপ নেয়। অথচ শিক্ষক যদি হাসিমুখে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করতে পারেন, তার ইতিবাচক প্রভাব শিক্ষার্থীদের মননে, আচরণে এবং শেখার মানসে অবধারিতভাবে প্রতিফলিত হয়। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে, শিক্ষককে অবশ্যই প্রেরণাসম্পন্ন, মর্যাদাবান এবং আর্থিক নিরাপত্তা-সম্পন্ন জীবনে অভ্যস্ত করতে হবে।

শিক্ষকের সম্মানেই জাতির অগ্রগতি

শিক্ষাখাতে অবকাঠামোগত বিনিয়োগ যত গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও বেশি জরুরি শিক্ষকস্বার্থের প্রতি সম্মানজনক মনোভাব। রাষ্ট্রের অনেক নাগরিকই বেসরকারি ব্যয়ে শিক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম। তাই প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার একটি অংশ পুরোপুরি বেসরকারি খাতে হস্তান্তরের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ওপর খরচের চাপ হ্রাস করা সম্ভব হতো। সেক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উভয়খাতের শিক্ষার মান উন্নয়নের পথও সুগম হতো। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, শিক্ষাকে সর্বজনীন মৌলিক অধিকার হিসেবে মেনে নেয়ার পর থেকে রাষ্ট্র সেই দায় এড়াতে পারে না।

বাংলাদেশে শিক্ষকদের অবস্থা বিবেচনায় নিলে আরো করুণ চিত্র ফুটে ওঠে। আফগানিস্তানের মতো দেশেও শিক্ষকদের নাগরিক সুবিধা আমাদের চেয়ে বেশি। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষক নিয়োগের দুর্বলতা। দলীয় বিবেচনা, নীতিহীন নিয়োগ এবং অশিক্ষক মানসিকতার লোকজনের অনুপ্রবেশ শিক্ষাব্যবস্থাকে চরমভাবে আঘাত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত এমন বহু ব্যক্তি শিক্ষক পরিচয়ে প্রবেশ করলেও তারা শিক্ষার আলো নয়, বরং নিজেদের অন্ধকারই বহন করে চলেছেন। এর ফলে প্রকৃত শিক্ষক সমাজের ওপর আস্থা কমে যাচ্ছে, প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে গোটা পেশাটি।

জুলাই বিপ্লবের ফলাফল ঘরে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজন ছিলো শিক্ষা খাত সংস্কারে। অথচ এক অজানা কারণে অন্য খাতে বারবার সংস্কার কমিশন গঠিত হলেও শিক্ষাখাত তেমনটি পায়নি। গত এক দশকে শিক্ষা খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—দলীয় নিয়োগ, নকল, প্রশ্নফাঁস, আর শতভাগ পাসের মতো তামাশার কারণে জাতির মেরুদণ্ড আজ প্রায় বিধ্বস্ত। শিক্ষার সব স্তরে দলীয় রাজনীতির বিষবাষ্প এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে, শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমের জায়গা দখল করেছে দলপ্রেম। ইতিহাসের খণ্ডিত চর্চায় আমরা একচোখা জাতি গঠনের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি।

রাষ্ট্রকে এখনই বুঝতে হবে—শিক্ষকদের সম্মানিত না করে উন্নত জাতি গঠন সম্ভব নয়। শিক্ষকের পেট খালি রেখে তার কাছ থেকে নির্ভেজাল জ্ঞান আশা করা নিছক নির্জলা কল্পনা। শিক্ষকও মানুষ, তার পরিবার আছে, সামাজিক দায়িত্ব আছে, জাগতিক প্রয়োজন আছে। তাকে যদি সম্মানজনক জীবনযাপন নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে শিক্ষার্থীদের চোখে তার মহত্ত্ব নির্মাণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে শিক্ষক যদি সমাজে মর্যাদা না পান, জাতি কোনোদিন মর্যাদার উচ্চতায় উঠতে পারবে না।

একটি মেধাভিত্তিক সমাজ গঠনে শিক্ষককে নেতৃত্বের আসনে বসাতে হবে। রাষ্ট্র যদি শিক্ষকদের স্বার্থ ও মর্যাদা নিশ্চিত করে, তবে জাতীয় স্বার্থও আপনা-আপনিই সুরক্ষিত হবে। ছিন্নবস্ত্রের গৌরবময় স্মৃতি দিয়ে আধুনিক শিক্ষার্থীদের মনোজাগতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই আজ সময় এসেছে রাষ্ট্রের কাছে স্পষ্ট দাবি জানানোর—শিক্ষকের মুখে হাসি ফোটাও, প্রজন্ম নিজেই আলোয় আসবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক

(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)

#এমপিও #শিক্ষক #উৎসব ভাতা