আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার্থীরা আরবি লিখতে না পারার নেপথ্যে | মাদরাসা নিউজ

আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার্থীরা আরবি লিখতে না পারার নেপথ্যে

বাংলাদেশে বহুমুখী শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে মাদরাসা শিক্ষা অন্যতম একটি প্রভাবশালী মাধ্যম।

#মাদরাসা #আরবি #শিক্ষার্থী #শিক্ষক

বাংলাদেশে বহুমুখী শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে মাদরাসা শিক্ষা অন্যতম একটি প্রভাবশালী মাধ্যম। মূল ধারার শিক্ষার্থীদের থেকে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট হলো তারা আরবি বলতে ও লিখতে পারে।

কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে মৌলিক এ বিষয়ে দুর্বল ভিত্তি নিয়েই শিক্ষাজীবন শেষ করছেন তারা। যার ফলে কর্মজীবনে গিয়ে লজ্জার সম্মুখীন হচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য আরবি ভাষায় দক্ষতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আরবি ভাষায় দক্ষ হলেই কেবল কুরআন-হাদিস ও ফিকহসহ অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করা সহজ হয়।

কিন্তু সাম্প্রতিকালে আলিম কিংবা ফাজিল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে তারা আরবিতে খুবই দুর্বল। ১০ কিংবা ১২ বছর মাদরাসায় পড়াশোনা করার পরেও অনেকে নিজের নামটি পর্যন্ত আরবিতে সঠিকভাবে লিখতে পারেন না।

সম্প্রতি এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক বলেছেন, দিনে দিনে যেন মাদরাসা শিক্ষা তার নিজস্ব যে স্বাতন্ত্র্য ছিল তা হারিয়ে ফেলেছে।

পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ থেকে শুরু করে সিলেবাস বা পরীক্ষা পদ্ধতিও যেন এখন সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে মিলে গেছে। মাদরাসাগুলোতে যেসব বই পুস্তক পড়ানো হচ্ছে সেখানে শুধু মলাটের ওপরে মাদরাসা বোর্ড লেখা জুড়ে দেওয়ার মধ্যেই দায় সারা হয়েছে।

ভেতরে মৌলিক বিষয়ে মাদরাসার জন্য পৃথক কোনো বৈশিষ্ট্য রাখা হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা মাদরাসায় পড়াশোনা করেও মাদরাসার আগের সেই গৌরব বা বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারছে না।

তিনি আরও বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ছাত্র ভর্তি হয়েছেন যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড মাদরাসা হলেও সঠিকভাবে অনেকে আরবিতে তার নিজের নামও লিখতে পারেন না।

মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আরেকটি দুর্বলতার দিক হচ্ছে আরবি ব্যাকরণ। বিভিন্ন মাদরাসার সিনিয়র ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে গত কয়েক বছরে মাদরাসার পাঠ্যবই ও সিলেবাসে ব্যাপকভাবে কাঁটছাঁট করা হয়েছে।

বিশেষ করে গত কয়েক বছরে মাদরাসা বোর্ডের উদ্যোগে আরবি ব্যাকরণের পুরনো গ্রন্থগুলো বাদ দিয়ে কাওয়ায়িদুল লুগাহ আল আরাবিয়্যাহ প্রণীত হয়েছে। মাদরাসা বোর্ডের কর্মকর্তারা তখন যুক্তি দেখিয়েছিলেন এই বলে যে, ওই সময়ের বিষয়গুলো ছিল পুরনো ধাঁচের এবং বর্তমান বাস্তবতায় কোনো প্রায়োগিক ব্যবহার বা প্রচলনও নেই।

তাই নতুন বিষয় বা নতুন বই পাঠ্য করা হয়। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা গেছে নতুন বই বা সিলেবাস চালু করার পর শিক্ষার্থীদের ভাষ্য দক্ষতা বৃদ্ধিতো পায়ইনি বরং ক্ষেত্রবিশেষে আরে হ্রাস পেয়েছে।

কিছু ক্ষেত্রে আবার পরীক্ষা পদ্ধতিও এর জন্য দায়ী। কেননা দাখিলে আরবি দ্বিতীয় পত্রে উত্তর আরবিতে দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও আলিমে এই বিষয়ের উত্তর বাংলাতেও দেয়া যায়। ফলে আলিমে গিয়ে আরবিতে দুর্বল হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চল থেকে প্রায়ই এমন অনেক অভিযোগ আসে যে, অধিকাংশ প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানে বছরের শুরুর দিকে শিক্ষার্থী এবং ওস্তাদ উভয়কেই ক্লাসে মূল আরবি কিতাব নিয়ে আসার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে গিয়ে আগের সেই মূল কিতাবের গুরুত্ব আর থাকে না। তখন থেকে মূল কিতাব পাশে রেখে যেনতেনভাবে অধ্যয়ন করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য গুরুত্ব দেওয়া হয়।

ফলে মূল কিতাবের ভাষা জ্ঞান এবং মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের আর তেমন আগ্রহও থাকে না। আবার এমনও অনেকে অভিযোগ করেছেন যে, মূল কিতাব তো দূরে থাক শ্রেণিকক্ষে খোদ শিক্ষকরাই মূল কিতাবের পরিবর্তে গাইড বই নিয়ে ক্লাসে আসেন।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে আলিয়া মাদরাসায় যেভাবে বিষয় ও নম্বর বাড়ানো হয়েছে সে তুলনায় শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়েনি। ফলে মাদরাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাকাঠামোর প্রতি অভিভাবকদের যে আশা ও সম্ভাবনার স্বপ্ন ছিল তার ১২ আনাও পুরণ হয়নি।

মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাস ও পাঠ্যবইয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুধু শিক্ষার্থীদের কাঁধে বইয়ের বোঝা তুলে দেওয়ার জন্যই যেন বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে দাখিলে ১৩০০ নম্বরের পরীক্ষা এবং আলিমে ১৫০০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া হয়।

এ ছাড়া পরীক্ষা নেওয়া হয় না এমন আরো ২ থেকে ৩টি অতিরিক্ত বিষয়ও আছে যে এগুলো ক্লাসে পড়ানো হয়। কিন্তু এরপরেও শিক্ষার্থীদের শিখন লিখনের ভিত্তি দুর্বলতা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যেও ক্ষোভ রয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিযোগিতার বিষয়টি মাথায় রেখেই এভাবে অযৌক্তিক এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো মাদরাসায় বাড়ানো হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের ভিত্তি সবল করার বিষয়ে সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা বা পরিকল্পনা কারো মাথায় কোনোকালেই ছিল না। আবার মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় সিলেবাস বা পাঠ্যবই নির্বাচনে বা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তিতেও শিক্ষার্থীদের মেধা বা তাদের ধারণ ক্ষমতাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

এ কথা সর্বজনগ্রাহ্য যে স্কুল কলেজের তুলনায় মাদরাসায় সাধারণভাবেই সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু তারপরেও স্কুল কলেজের তুলনায় মাদরাসাগুলোতে বিষয় এবং সিলেবাসের চাপ বেশি।

একই সঙ্গে স্কুল কলেজের সাথে তুলনামূলক প্রতিযোগিতার বিচারেই মাদরাসাগুলোতে এমন সব বিষয় বা কনটেন্ট পড়ানো হয় যা মাদরাসা শিক্ষার সাথে কোনোক্রমেই সঙ্গতিপূর্ণও নয়।

কিন্তু এরপরেও সেগুলো হরহামেশাই মাদরাসায় পড়ানো হয়। যেমন বাংলা বইয়ের কিছু বিষয় এবং চার-কারু বিষয়ের মতো অনেক বিষয় উল্লেখ্য।

আরবি বলতে ও লিখতে না পারার বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বলছেন, মাদরাসা লাইনে ভালো ফলাফল করতে হলে রবি ভাষা কিংবা কিতাব বিষয়ে দক্ষ হতে হবে বিষয়টি এমন নয়। অন্যান্য সাধারণ বিষয়ে ভালো প্রস্তুতি নিতে পারলে আরবি ভাষা কিংবা কিতাবে কিছুটা দুর্বল হলেও তেমন কোনো অসুবিধা হয় না।

তাই অনেক শিক্ষার্থী স্কুল কলেজের পাশাপাশি মাদরাসা থেকেও তারা দাখিল কিংবা আলিমে ভালো ফলাফল করছেন। তাদের বর্ণনায় ভালো ফলাফলের জন্যই মাদরাসার শিক্ষার্থীরা মূল আরবি কিতাবে আগ্রহ কম দেখায়। ফলে বাস্তবিক অর্থেই দক্ষতা অর্জনে তারা পিছিয়ে পড়ছে।

শিক্ষার্থীরা আরও জানান, মাদরাসা বোর্ডে অতীতে দেখা গেছে গাইড বইয়ের আলোকেই প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়। ফলে কয়েকটি গাইড বইয়ের সহায়তা নিয়েই পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালোভাবে নেয়া সম্ভব।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মিগ্রা মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, বিগত সরকারের আমলে আলিয়া মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থাকে একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে মাদরাসা থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরেও চাকরির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছে না। ফলে অনেকেই হতাশ হয়ে মাদরাসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, মাদরাসা শিক্ষাকে কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবেই দমিয়ে রাখার কৌশল নেওয়া হয়েছিল। আমরা বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ পেয়েছি অনেক মাদরাসায় নিয়মিত পাঠদান ব্যাহত হয়েছে এবং কোথাও কোথাও অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত নম্বর প্রদান করা হয়েছে, যা শিক্ষার গুণগত মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মাদরাসা শিক্ষাকে আরও আধুনিকভাবে ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দিয়ে বলেছেন আগামী অর্থবছরে প্রতিটি জেলায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি ভবন নেই, সেখানে ভবন বরাদ্দের উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি মেধাবী ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থাও থাকবে।

মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, অচিরেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বিপ্লব আসছে।

আমরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আলিয়া মাদরাসাকে তার যথাযোগ্য অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে সম্মিলিতভাবে কাজ শুরু করেছি।

#মাদরাসা #আরবি #শিক্ষার্থী #শিক্ষক