বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুলিশের ভূমিকা বরাবরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বিভিন্ন সময়ে এই বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠে। যা জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
একদিকে যেমন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জননিরাপত্তা বিধানে পুলিশের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য, তেমনি অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সাধারণ মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ এই বাহিনীর ভাবমূর্তিকে করেছে কলুষিত।
রাজপথের কর্মসূচিতে পুলিশের মারমুখী আচরণ এবং কোথাও কোথাও সহনশীলতার দৃষ্টান্ত–এই দ্বিমুখী চিত্র জনমনে জন্ম দিয়েছে বহু জিজ্ঞাসার।
বিশেষত, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পালাবদলের পর পুলিশের একাংশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বর্তমানেও সাধারণ মানুষের হয়রানির অভিযোগ বিদ্যমান থাকায়, এই বাহিনীর নিরপেক্ষতা ও জনবান্ধব হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পুলিশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যের গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের ‘লেজুরবৃত্তি’ ও ‘দমন পীড়ন’ চালানোর অভিযোগ একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এই ঘটনা একদিকে যেমন রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগকে জোরালো করে, তেমনি অন্যদিকে পুলিশের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরে।
তবে বাস্তবতা হলো, এই পটপরিবর্তনের পরেও সাধারণ মানুষের হয়রানি এবং সরকার সমর্থক ও বিরোধী গোষ্ঠীর প্রতি পুলিশের ভিন্ন ভিন্ন আচরণের অভিযোগ এখনো শোনা যাচ্ছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, থানায় থানায় মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো এবং অর্থ আদায়ের নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে।
ঢাকার রাজপথেও দেখা যায়, সরকার সমর্থক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কর্মসূচিতে পুলিশ প্রায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে, অথচ সাধারণ মানুষের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনকালে তারা কঠোর ও দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
এই প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের মনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বারবার উঁকি দেয় – পুলিশ কি কখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধরদের পক্ষ ত্যাগ করে সম্পূর্ণভাবে সাধারণ মানুষ ও রাষ্ট্রের সেবায় নিয়োজিত হতে পারবে না?
পুলিশের এই দ্বিচারিতা এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সমালোচনা অতীতেও বিশিষ্টজনরা করেছেন। তাদের সেই মূল্যবান মতামত এবং পুলিশের সামগ্রিক ভূমিকা নিয়ে একটি বিস্তৃত আলোচনা সময়ের দাবি।
বিশিষ্টজনদের মতে, পুলিশের দ্বিচারিতার মূল কারণ নিহিত রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব এবং কাঠামোগত দুর্বলতায়। দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যের উপর নির্ভরশীল থেকেছে।
এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই পেশাদারিত্বের পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে। ক্ষমতাশীন দলের স্বার্থ রক্ষায় অনেক পুলিশ সদস্য অতি উৎসাহী ভূমিকা পালন করেন।
যা সাধারণ মানুষের অধিকার ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম তার বিভিন্ন লেখায় পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, কীভাবে বিভিন্ন সময়ে পুলিশকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন এবং সরকারি দলের প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করা হয়েছে।
তার মতে, পুলিশের এই ধরনের আচরণ কেবল আইনের শাসনের পরিপন্থী নয়, বরং এটি একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
তিনি পুলিশের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের উপর জোর দিয়েছিলেন। যা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্তভাবে পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে পারবে।
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়ে বহুবার সোচ্চার হয়েছেন।
তিনি বলেন, “পুলিশ জনগণের বন্ধু হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই তারা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষেরা পুলিশের অন্যায় আচরণের শিকার হন বেশি।”
তিনি উল্লেখ করেন, থানায় অভিযোগ নিতে গড়িমসি করা, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো এবং গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করা – এগুলো পুলিশের দৈনন্দিন চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য একটি কার্যকর অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। যেখানে সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে তাদের অভিযোগ জানাতে পারবে এবং তার সুষ্ঠু তদন্ত হবে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তার বিভিন্ন বক্তব্যে পুলিশের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের অভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতেন। তিনি বলতেন, “আইনের রক্ষক যদি নিজেরাই আইন ভঙ্গ করেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কার কাছে যাবে?”
তিনি পুলিশের প্রশিক্ষণ এবং মূল্যবোধের উন্নয়নের উপর জোর দেন। তার মতে, পুলিশ সদস্যদেরকে আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া অপরিহার্য। পাশাপাশি, তাদের মধ্যে সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও জনসেবার মানসিকতা গড়ে তোলাও জরুরি।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ তার বিভিন্ন নিবন্ধে পুলিশের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে লিখতেন, কীভাবে পুলিশ একটি ‘ভয়াবহ প্রতিষ্ঠানে’ পরিণত হয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য এবং মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার – এই উভয়ই জনমনে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।
তিনি পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপরও জোর দেন। তার মতে, সরকার যদি সত্যিই একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী দেখতে চায়, তাহলে তাদেরকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো রাজপথের কর্মসূচিতে তাদের আচরণ। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল বা সাধারণ মানুষের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনকালে পুলিশ প্রায়শই লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ব্যবহার করে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শান্তিপূর্ণ মিছিলেও পুলিশ সদস্যরা মারমুখী হয়ে ওঠেন এবং নির্বিচারে ধরপাকড় চালান।
এর বিপরীতে, সরকার সমর্থক দলের কর্মসূচিতে পুলিশ সাধারণত নমনীয় আচরণ করে এবং অনেক সময় আইন লঙ্ঘনের ঘটনায়ও নীরব থাকে।
এই বৈষম্যমূলক আচরণ পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং জনমনে ক্ষোভের জন্ম দেয়।
তবে একথাও অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশ পুলিশ মাঝে মাঝে কিছু সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কাজ করে সাধারণ মানুষের প্রশংসা অর্জন করেছে।
দুর্যোগকালে ত্রাণ বিতরণ, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার কিছু উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য।
কিন্তু এই ধরনের বিচ্ছিন্ন কিছু ভালো কাজ সামগ্রিকভাবে পুলিশের বিতর্কিত ভাবমূর্তিকে পুরোপুরি ঘোচাতে পারেনি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পুলিশের কিছু সদস্যের গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা।
এর মাধ্যমে হয়তো একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি বরদাস্ত করা হবে না।
তবে এই শুদ্ধি অভিযান কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হবে, তা এখনো দেখার বাকি। বর্তমানেও বিভিন্ন থানায় সাধারণ মানুষের হয়রানির খবর এবং রাজপথে পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণ অব্যাহত থাকায়, জনমনে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
পুলিশ কি তাহলে কোন শিক্ষা নেয় নি। তাদের সাবেক আইজিপিদেরও জেল খাটতে হচ্ছে। এখন যা করছে তার জন্য পূর্বসূরিদের পরিণতি তাদের জন্যও যদি অপেক্ষায় থাকে!
বাংলাদেশ পুলিশের সামনে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একদিকে যেমন তাদেরকে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে একটি নিরপেক্ষ ও জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কার, জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং আইনের শাসনের প্রতি অবিচল আস্থা।
বিশিষ্টজনদের মতামত এবং সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা – এই উভয়কেই বিবেচনায় নিয়ে পুলিশকে তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে।
অন্যথায়,‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধরদের পক্ষ ত্যাগ করে কখনোই কি সাধারণ মানুষ বা রাষ্ট্রের পুলিশ হয়ে ওঠবে না’ – এই প্রশ্নটি দীর্ঘকাল ধরে অমীমাংসিতই থেকে যাবে।
একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশের নিরপেক্ষতা ও জনবান্ধব ভূমিকা অপরিহার্য, এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।