সমুদ্র আমাদের বেঁচে থাকার ভিত্তি | মতামত নিউজ

সমুদ্র আমাদের বেঁচে থাকার ভিত্তি

মুগ্ধতা ছড়িয়ে অপার বিস্ময়ে সমুদ্র আমাদের কাছে টানে। পৃথিবী নামক এই ছোট গ্রহের ৭০ ভাগ জল আর ৩০ ভাগ স্থল। মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে পৃথিবী সৃষ্টির সময় মহাসাগরগুলো বিভক্ত হয়। বিশাল বিশাল পাঁচটি মহাসাগর একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। মহাসাগরের বিশালতার কাছে ৮৫০ কোটি মানুষের বসবাসের সাতটি মহাদেশকে অনেক বেশি ক্ষুদ্র মনে হয়।

#মতামত

সাগর-মহাসাগরের বিশালতায় রয়েছে দুর্বার আকর্ষণ। মুগ্ধতা ছড়িয়ে অপার বিস্ময়ে সমুদ্র আমাদের কাছে টানে। পৃথিবী নামক এই ছোট গ্রহের ৭০ ভাগ জল আর ৩০ ভাগ স্থল। মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে পৃথিবী সৃষ্টির সময় মহাসাগরগুলো বিভক্ত হয়। বিশাল বিশাল পাঁচটি মহাসাগর একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। মহাসাগরের বিশালতার কাছে ৮৫০ কোটি মানুষের বসবাসের সাতটি মহাদেশকে অনেক বেশি ক্ষুদ্র মনে হয়। জলীয়বাষ্পের সবচেয়ে বড় উৎস এই মহাসাগরগুলো। যা পানিচক্রের ভারসাম্য বজায় রেখে পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতকে টিকিয়ে রেখেছে। নিরক্ষীয় অঞ্চলের উষ্ণ পানি ও মেরু অঞ্চলের শীতল পানির ভারসাম্য রক্ষা করে গ্রহের তাপমাত্রা ঠিক রাখে এই সাগর-মহাসাগর।

প্রতিবছর ৮ জুন ‘আন্তর্জাতিক মহাসাগর দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে এই দিবস পালনের প্রাথমিক অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। সেবছর ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরোতে সংঘটিত ধরিত্রী সম্মেলনে দিবসটি পালনের বিষয়ে আলোচনা হয়। অতঃপর ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের পর জাতিসংঘ এই দিবসকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বের পরিবেশ সুরক্ষায় মহাসাগরের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে মহাসাগরের তুলনা নেই। মূলত মহাসাগরের গুরুত্ব আরো বেশি করে উপলব্ধি করার প্রয়াসে দিবসটির সূচনা।

সমুদ্র পৃথিবীর জলবায়ুকে সহনীয় করে রাখে এবং জলচক্র, কার্বনচক্র ও নাইট্রোজেন চক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমুদ্রে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া,প্রোটিস্ট, শৈবাল, উদ্ভিদ, ছত্রাকের বাসস্থান। এই জন্য সমুদ্রে একটি বৈচিত্রময় সামুদ্রিক বাসস্থান ও বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে। সমুদ্র মানবজাতিকে খাদ্য সরবরাহ করে। এর মধ্যে মাছই প্রধান। এছাড়া শেলফিস, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও সামুদ্রিক শৈবাল পাওয়া যায় সমুদ্র থেকে। মানুষ সমুদ্রকে ব্যবহার করে বাণিজ্য, পর্যটন, খনিজ উত্তোলন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যুদ্ধ ও সাঁতার, প্রমোদ ভ্রমণ, অবকাশযাপন ইত্যাদি কাজ করে। এই সব কাজকর্মের জন্য মানুষ যেমন লাভবান হচ্ছে তেমনি আবার সমুদ্রকেও দূষিত করছে।

পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি প্রাণী প্রজাতি বাস করে সমুদ্রের নীচে। এই সব প্রাণী সমুদ্রের নীচে বাস করলেও সমুদ্রের উপরিভাগে প্রাণীদের রক্ষায় তাদের অবদান ব্যাপক। ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার অব মেরিন স্পেসিসের মতে, সমুদ্রে দুই লাখের বেশি প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। কর্মসংস্থান ও সামুদ্রিক খাবার সংগ্রহের বিষয়টি বিবেচনা করলে সমুদ্রের অবদান অনস্বীকার্য। এক তথ্যে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬ কোটি মানুষকে কর্মসংস্থান দেয় সমুদ্র। সেই হিসেবে এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির বিশাল ক্ষেত্র। গভীর মহাসাগর (২০০ মিটার থেকে শুরু) জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, অক্সিজেন উৎপাদন, বৃষ্টিপাত, খাদ্য ও ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জানা যায়, সমুদ্রপৃষ্ঠে বসবাসকারী ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন পৃথিবীর প্রায় ৫০ ভাগ অক্সিজেন উৎপন্ন করে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ওশানিক সার্ভিস’ জানায়, সামুদ্রিক প্ল্যাঙ্কটন, শৈবাল এবং সমুদ্রের তলদেশে থাকা অন্যান্য উদ্ভিদ পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি অক্সিজেনের জোগান দেয়। মহাসাগরগুলো পৃথিবীর প্রায় ৬০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপাদন করে। সমুদ্রের নীচে থাকা সামুদ্রিক প্রজাতিই এই অক্সিজেন উৎপাদন করে। সমুদ্র গবেষকদের তথ্য মতে, সাগরের মাত্র ১ শতাংশেরও কম জায়গা জুড়ে রয়েছে সামুদ্রিক প্রবাল। সমুদ্রের অগভীর পানিতে বাস করা এই প্রবাল সমুদ্রের অন্যান্য সামুদ্রিক জীবকে বাঁচতে সহায়তা করে। এককথায় অক্সিজেন উৎপাদন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ উভয় কাজ করে থাকে সমুদ্র। ‘জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেলে’র (আইপিসিসি) হিসাবে সমুদ্র পৃথিবীর প্রায় ২০ শতাংশের বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। ফলে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো হ্রাস করে।

আমরা যে শ্বাস গ্রহণ করি ও খাবার খাই তার বেশিরভাগ উৎস এই সমুদ্র। প্রতিদিনের আবহাওয়া পরিবর্তন ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে মহাসাগরের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। সাগর-মহাসাগর কার্বনের সবচেয়ে বড় শোষণকারী হিসেবে কাজ করে। আমাদের গ্রহের জীববৈচিত্র্যের সবচেয়ে বড় আধার সমুদ্র। পৃথিবীর মোট প্রাণবৈচিত্র্যের প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ সামুদ্রিক। মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন সমুদ্রে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলছে। মাত্রাতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের অতি ব্যবহার ও এসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি সমুদ্রের ভারসাম্য যেমন নষ্ট করছে তেমনি খাদ্যশৃঙ্খলকে ধ্বংস করছে। এছাড়া রাসায়নিক ও প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রের দূষণকে ত্বরান্বিত করছে। পৃথিবী নামক এই ছোট্ট গ্রহের তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাগর-মহাসাগরের জীববৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সমুদ্র তাপ শোষণ করে বায়ুমণ্ডল শান্ত রাখে।

সম্প্রতি ‘এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি’র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। শুধু প্লাস্টিক নয় আরো রয়েছে তেল, কেমিক্যালসহ নানা রকম বর্জ্য। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) এর তথ্যমতে, সমুদ্রের এক বর্গমাইলের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি প্লাস্টিকের বোতল ভাসতে দেখা যায়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফি সেন্টারসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মাধ্যমে নাসার উপগ্রহের ধারণ করা ছবি বিশ্লেষণ করে অবাক করা তথ্য তুলে ধরেছেন। তথ্যে সাগর-মহাসাগরের রং পরিবর্তনের বিষয়টি উঠে এসেছে। তারা জানিয়েছেন, মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ড ও জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের দরুণ সমুদ্রের রং ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। জাতিসংঘের এক তথ্যে জানা যায়, দূষণের কারণে সমুদ্রে ৭০ শতাংশ বড় মাছের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে এবং ৪০ শতাংশ প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হয়ে গেছে। জানা যায়, সামুদ্রিক আবর্জনার আনুমানিক ৮০ শতাংশই আসে সমুদ্রের বাইরের উৎস থেকে। এর বেশিরভাগই প্লাস্টিক বর্জ্য। বাকি ২০ শতাংশ বর্জ্য আসে সমুদ্রভিত্তিক উৎস থেকে। পৃথিবীর বড় বড় নদনদী হয়ে সাগর-মহাসাগরে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হচ্ছে। যার মারাত্মক প্রভাবে হাজার হাজার সামদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে।

বাংলাদেশের মোট সমুদ্র অঞ্চল ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। ব্লু ইকোনমি বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এই বিশাল সমুদ্র অঞ্চল দূষণের হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়ে শুশুক, তিমি, ডলফিনসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর করুণ অবস্থার কথা খবরে আসে। ছোট ছোট নদীর দূষণ ছড়িয়ে পড়ে বড় নদীতে। আর বড় নদ-নদীর দূষণ জমা হয় সমুদ্রে। শহরাঞ্চলের দূষণ কোনো না কোনোভাবে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। ক্রমবর্ধমানভাবে প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি ও ত্রুটিপূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে প্লাস্টিক দূষণ অব্যাহত থাকলে ২০৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। তাই দেশে ‘সমুদ্র মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা যেতে পারে। এছাড়া দরকার সামুদ্রিক সংরক্ষণ নীতিমালা। সমুদ্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা পেলে দূষণ ঠেকানো যেমন গুরুত্ব পাবে তেমনি সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহার সম্ভব হবে।

মানুষের কার্যকলাপ যুগের পর যুগ ধরে সমুদ্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের অসচেতন কার্যকলাপে সমুদ্রের ওপর চাপ বাড়ছে। মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সমুদ্রের ওপর। পরম বন্ধু শান্ত সমুদ্র মানুষের কখনো শত্রু হতে পারে না। ৩০ ভাগ স্থলে বসবাসকারী মানুষের নেতিবাচক ও প্রকৃতিবিরুদ্ধ কার্যকলাপ বন্ধ না করলে ৭০ ভাগ সমুদ্রও বাঁচানো সম্ভব হবে না।

আর সমুদ্র টিকে না থাকলে স্থলভাগের অস্তিত্বও থাকবে না। সমুদ্র একসঙ্গে দুটো কাজ করছে। একদিকে মানবসৃষ্ট জলবায়ুর প্রভাবে ভূমিকা রাখছে অপরদিকে অক্সিজেন সরবরাহ, খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানে সহায়তা করছে। সমুদ্রের স্বাস্থ্যের ওপর আমাদের স্বাস্থ্য নির্ভর করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই নেতিবাচক বাস্তবতায় সাগর-মহাসাগরকে সব ধরনের দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে না পারলে সমগ্র মানবসভ্যতার জন্য মহাবিপদ অপেক্ষা করছে। খাদ্য ও সুপেয় পানির নিরাপত্তায় সমুদ্রকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। জলজ প্রাণিজগৎ যত বেশি বিপন্ন হবে জলবায়ু সমস্যা তত বাড়বে। ছোটবেলা থেকেই মানুষের মধ্যে সমুদ্র শিক্ষা দরকার। মানুষ তার জীবনে সমুদ্রের অবদান যত বেশি জানবে ততই সমুদ্রের কাছে ঋণী থাকবে।

লেখক: শিক্ষক

#মতামত