মাছুম বিল্লাহ। ছবি : দৈনিক শিক্ষাডটকম
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত হয়। সেখানে নিজস্ব আয় নিতান্তই নগণ্য। তাদের আয়ের উৎস থাকা প্রয়োজন, আয় বাড়াতে হবে সেটি আমরা সমর্থন করি। কিন্তু সেটি হতে হবে ইনোভেটিভ পন্থায়, ক্রিয়েটিভ পন্থায়।
অসহায় ভর্তিচ্ছুদের ফি বাড়িয়ে অর্থ আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপার্জন বাড়ানো খুব একটি সৃজনশীল কাজ নয়। এটি অনেকটা রাস্তাঘাটে যখন সমস্যা হয় তখন রিকশা ও ভ্যানওয়ালারা পঞ্চাশ টাকার ভাড়া বাড়িয়ে তিনশত টাকা নেওয়ার মতো। অসহায় পথিকরা তখন উপায়ন্তর না দেখে সেই টাকাতেই ঐসব বাহনে চড়ে থাকেন। এখানে সৃজনশীলতার কিছু নয়, সাহসের কিছু নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করতে পারে, ক্যান্টিন চালাতে পারে তাতে এক দিকে যেমন অর্থ উপার্জন হবে অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করা যাবে। সেখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কিছুই করতে পারেনা। ক্যাডার, সন্ত্রাসী, ছাত্রনেতা ইত্যাদি কারণে এসব চিন্তাভাবনার ধারেকাছেও যেতে পারেনা।
নামমাত্র ক্যান্টিন থাকে আর বাইরে থেকে ক্যাটারার আনা হয়। তারা যদি ছাত্রনেতাদের লোক হয়, তাহলে ক্যান্টিন কোনোরকম চালাতে পারে কিন্তু কোনো ধরনের উন্নত খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেনা। আর যদি অন্য ধরনের ক্যাটারার হয় তাহলে ছাত্রনেতাদের বাকী খাইয়ে দেউলিয়া হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে চলে যায়।
শিক্ষার্থীরা তখন অস্থায়ীভাবে নির্মিত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ছাপড়া দোকানে খাওয়া-দাওয়া করে আর দিনগুনতে থাকেন কবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হবে, কবে খাবারের কষ্ট দূর হবে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এসব জায়গায় কিছু করতে পারেনি, চেষ্টাও করছে না। যদি কিছু করতে পারে সেটা হবে প্রশংসার ও নতুন ধরনের সাহসের কাজ। সেই ধরনের সাহস কেউ দেখাচ্ছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খাবার আর সরকারি হাসাপাতালের চিকিৎসা সেবা আর ঔষধ প্রায় একই ধরনের। গুচ্ছ পরীক্ষা থেকে বের হওয়া কোনো সাহসের কাজ নয়, যেটি আমরা পত্রিকায় দেখলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বলেছেন।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য দেশের আনাচে কানাচে থেকে আসা শিক্ষার্থীরা সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে দিনরাত কাটায়। এটা একটা বড় জাতীয় সমস্যা। উদ্বিগ্ন থাকেন তাদের অভিভাবক। ঘটে অনেক ধরনের অঘটন, দুর্ঘটনা। নিজ দেশে বসে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হিসেবে আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করি তারা বারবার অনুরোধ করেছি সব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে যে, শিক্ষার্থীরা যাতে নিজ জেলায় বসে, অতিরিক্ত হলে নিজ নিজ বিভাগে বসে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। সেটি এখনও আংশিক করা হয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রেজাউল করিম বলেছেন, গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিলো সাহসী একটি পদক্ষেপ। আমাদের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় তা সফলভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। এ উদ্যোগের ফলে জবির মর্যাদা যেমন বেড়েছে, তেমনি রাজস্ব আয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। প্রাপ্ত অর্থ শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, অ্যাকাডেমিক সুবিধা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। উপাচার্য এটিকে একটি সাহসী পদক্ষেপ বলেছেন কিন্তু এখানে সাহসের তেমন কিছু নেই।
গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করাটাই সাহসের বিষয় ছিলো, চ্যালেঞ্জিং ছিলো। কারণ এটি পুরাতন নিয়মের ভর্তি পরীক্ষা যা স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় নিতো সেটির বিপক্ষে এক চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকরা নিজেদের ক্যাম্পাসে পরীক্ষা নিতেন, নিজ বাসায় থেকে, কিংবা শহরে থেকে প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পরীক্ষা নিতেন তাতে তাদের তেমন কোনো কষ্ট হতোনা বরং ভর্তি পরীক্ষা বাবদ কিছু অর্থিক সুবিধা পেতেন। সেটি গুচ্ছ পরীক্ষাতেও পাওয়া যায়, পরিমাণে হয়তো কম আর কিছু শিক্ষকদের হয়তো নিজ ক্যাম্পাস ছেড়ে দুরে কোথাও যেতে হতো। সেই কষ্টটুকু তারা করতে চাচ্ছিলেন না, তাই গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়াটাই কঠিন। সেটি যারা নিতে পেরেছেন তারা বরং বলতে পারেন যে, এটা সাহসী পদক্ষেপ ছিলো।
শিক্ষকদের সামান্য একটু কষ্ট আর আর্থিক সুবিধায় কিছুট কমতি মুলত গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজী করানো যাচ্ছিলো না। অনেক অনুনয় বিনয় করে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজী করালে পরবর্তী বছর আবার তারা বেড়িয়ে যায়।
ইউজিসি তাদের অনুরোধ ছাড়া কিছু করতে পারেনা। মাউশি অধিদপ্তরের অধীনে কলেজগুলোতে এ ধরনের সমস্যা হলে হয়তো দু’ চারজনের ট্রান্সফার করা যেতো কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তো সেটা প্রযোজ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক বিশেষ করে যারা পাওয়ারফুল তারা যা মনে করেন তা-ই করতে পারেন। আর তারাই আবার ভিসিদের পরিচালনা করেন। অতএব ভিসির সাহসী পদক্ষেপকে আমরা তেমন একটা স্বাগত জানতে পারছিনা।
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য ভর্তি পরীক্ষা আজ ঢাকা, কাল রাজশাহী, পরেরদিন চট্টগ্রাম এমনকি সারাদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে রাতের বেলা জার্নি করে চট্টগ্রামে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে হয়। তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি, পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে না পারা, রাস্তার পাশের হোটেল রেস্তোরার খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া, থাকার ভাল জায়গা না থাকা আর অর্থের অপচয়---এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে খুব একটা ভাবায় না।
সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় নারী শিক্ষার্থীদের। তারা তো একা চলাফেরা করতে পারেননা নিরাপত্তার কারণে। তাদের সাথে বাবা-মা, ভাই-বোন কিংবা নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে নিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। তাদের জীবনে ঐ কটি দিন যে, অমানিশার আধার নেমে আসে সে বিষয় নিয়ে বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় বহুবার লিখেছি কেন গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে হবে।
অনেকেই লিখেছেন। নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছি। অমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই সেই আশির দশকে। বরিশাল থেকে ঢাকা আসতাম লঞ্চে, সারারাত না ঘুমিয়ে। ঢাকায় নেমে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় না গিয়ে সরাসরি চলে যেতাম জাহাঙ্গীরনগর, গিয়ে শুনতাম পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে। তখন মোবাইল, ইন্টারনেটের যুগ নয়। তারা দু একটা পত্রিকায় প্রকাশ করেছে যা অনেকের চোখে না পড়ারই কথা। ছোট্ট দু চারলাইন কোন পৃষ্ঠায় রয়েছে, তার খবর কে রাখে। আবার আসতাম, এসে শুনতাম হরতাল, তাই পরীক্ষা পেছাতে হয়েছে , কিংবা পরদিন হরতাল। এভাবে বহুবার হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ঘুরে দেখলাম অনেক শিক্ষার্থী এক বিছনায় শোয়ার জায়গা নেই, কাউকে কাউকে দেখলাম ধোপার রুমে শুয়ে আছেন, তাও একজন নয়। এই দৃশ্য আমাকে তখনই কাঁদাতো যে, দেশের উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই দশা! এগুলো থেকে জাহাঙ্গীরনগরের দৃশ্য হাজারগুণে ভাল ( অন্তত তখন ছিলো)। সবার হলে সিট আছে, অনেক শিক্ষার্থী একা থাকে কারণ রুমমেট ঢাকার বাসায় থাকে কিন্তু তার হলে সিট আছে। এসব কারণে অনেক শিক্ষার্থীই তখন জাহাঙ্গীরনগরকে পছন্দ করতো।
গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার নজির বহু বছর আগেই আমাদের দেশে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় শুরু হয়েছে এবং সামান্য সমস্যা ছাড়া সুন্দরভাবেই চলছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজিই করানো যাচ্ছেনা। তার কারণ এবার ভালভাবে বেড়িয়ে এলো দেশের একমাত্র শিক্ষাবিষয়ক ডিজিটাল পত্রিকা ‘দৈনিক শিক্ষাডটকম’ ও জাতীয় প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’র প্রতিবেদন থেকে। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ১২ কোটি টাকা আয় করেছে।
৩০ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০২তম সিন্ডিকেট সভায় এ তথ্য জানানো হয়। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিমের সভাপতিত্বে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ২৯৭ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করেন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিনা শরমীন, যা পরে সিন্ডিকেটে অনুমোদিত হয়। কোষাধ্যক্ষ ড. সাবিনা শরমীন জানান, ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত মিলিয়ে এবার প্রায় ১২ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। নিজস্বভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের ফলে একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা রক্ষা পেয়েছে, অন্যদিকে বড় অঙ্কের অর্থনৈতিক সাফল্যও অর্জিত হয়েছে যা ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যবহার করা যাবে।
দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৪টির মতো। তার অর্ধেক বা তিনভাগের এক ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও যদি ভর্তিচ্ছুদের ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় তাহলে তাদের শারীরিক ও আর্থিক যে সমস্যা হচ্ছে বা হবে সেগুলো দূরীকরণের জন্য অবশ্যই গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে হবে যাতে শিক্ষার্থীকে দেশের আনাচে-কানাচে রিস্ক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে না হয়। পূর্ববর্তী সরকার জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করার ফাঁদ পেতেছিলো। প্রথমত অর্থ লোপাটের জন্য, দ্বিতীয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মূল ধারণা সেটি পাল্টানোর অভিপ্রায়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ধারণা ও ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য দেশে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভাগ, হল ও শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ানো যেতো। সেই ধারণা বাদ দিয়ে দেশে জমির বিশেষ করে কৃষি জমির স্বল্পতা সত্ত্বেও বহু জমি নষ্ট করে স্কুল বা ছোট ছোট কলেজের মতো বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো সবই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখন শিক্ষার্থীদের যদি তারা নিজেদের লাভের জন্য সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে ভর্তি পরীক্ষা নেয়, সেটি কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
গুচ্ছের বাইরে ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এটি মেনে নেয়া যায় কিন্তু ইচ্ছে করে সবাই যদি নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা নেয় সেটি কাম্য নয় এবং শিক্ষার বৃহত্তর কল্যাণের জন্যও এটি সমর্থনযোগ্য নয়।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক