প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগ্রামী ঐতিহ্য আজ বিপর্যস্ত | শিক্ষাবিদের কলাম নিউজ

প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগ্রামী ঐতিহ্য আজ বিপর্যস্ত

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের পাবনা জেলার তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রাঙ্গনে নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।

#প্রাথমিক বিদ্যালয় #শিক্ষক

প্রাথমিক শিক্ষা আজ বিপর্যস্ত। তার মূলে রয়েছে,শিক্ষক সংগঠনের অনৈক্য। নেতৃত্বের অহংকার। অনেকটা ‘গায়ে মানেনা, আপনি মোড়ল’। ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার’ প্রবাদের মতো ।

ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বা সংগ্রামের মানসিকতা না থাকলেও, দালালি বা চামচামির ক্ষেত্রে অনৈক্যের ঘাটতি নেই। সমাজে তেল অনেকেই মর্দন করে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি নেতারা এক্ষেত্রে শীর্ষে। আজ বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সংগ্রাম, সাফল্য ও প্রেরণার ৮৮ বছরের ঘটনাবহুল আলোচিত বিষয় নিয়ে আলোকপাত করছি-

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের পাবনা জেলার তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রাঙ্গনে নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। পরবর্তীতে সংশোধন করে নামকরণ করা হয়েছে, ‘নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’। তৎকালীন শাসক ইংরেজরা জমিদারদের মাধ্যমে গরিব প্রজাদের ওপর অমানবিক নিষ্ঠুর নির্যাতন করতেন।

তখনকার শাসক শ্রেণি নির্যাতন থেকে গুরুসমাজ তথা প্রাথমিক শিক্ষক সমাজও রেহাই পেতোনা। তখনকার শিশুশিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো, গ্রামীণ পাঠশালা। অনেকটা মক্তব ভিত্তিক। শিক্ষকদের কোনো মাসিক বেতন বা অনুদান ছিলোনা। অভিভাবকেরা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী অর্থ, চাল, ডাল, মাছ, তরকারিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিতেন। তখনকার সময় ছিলো এক দুর্বিসহ জীবন। পাঠদানের কোন নিদিষ্ট পাঠ্যপুস্তক বা কোনো নিদিষ্ট পদ্ধতি ছিলো না। বেশিরভাগ মক্তব ছিলো কাছারিঘরভিত্তিক।

১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বেভারেজ লালবিহারী দে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে একটি পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন। এদিকে ইংরেজদের প্রশাসনিক সহযোগিতা জন্য কিছু কেরানি বা লেখাপড়া জানা জনবল প্রয়োজন দেখা দেয়। ইংল্যান্ড থেকে এ ধরনের অল্প শিক্ষিত জনবল আনা সম্ভব ছিলো না। তাদের স্বীয়স্বার্থে ও জমিদাররা নিজদের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য অল্প কিছু প্রাথমিক ও উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তখনকার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা দুই স্তরে বিভক্ত ছিলো। নিম্ন প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২য় শ্রেণি পর্যন্ত নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান করা হতো। কিন্তু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গরিব মানুষের সন্তানদের লেখা পড়ার সুযোগ ছিলো না। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে গোপালকৃষ্ণ গোশলে কেন্দ্রীয় আইন সভায় প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে একটি সুচিন্তিত প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। কিন্তু তা গৃহীত হয়নি।

অবশেষে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রীসভা বাংলার আইনসভায় বিলের প্রস্তাব করেন। এতে জমিদার শ্রেণি বিলটির বিরোধিতা করেন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম আইন সারা প্রদেশে এ কার্যকর হলো। এতে তৎকালীন শিক্ষক সমাজের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে। বিলটি পাস হওয়ার পর কার্যকর করার ক্ষেত্রে জমিদারশ্রেণি চরম বিরোধিতা করেছিলেন। শিক্ষক সমাজ উপলব্ধি করেছিলেন, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া এ আইন কার্যকর করা যাবেনা। এ উপলব্ধি থেকে মক্তব ও পাঠশালার শিক্ষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠন গড়ে তোলেন।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গ্রামাঞ্চলের গরীব কৃষকসহ প্রজাদের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য রুরাল প্রাথমিক শিক্ষা আইন Bengal Rural Education Act 1930 কার্যকর করেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ এতে উপকৃত হয়েছিলো। তখন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন, স্যার আজিজুল হক। তিনি সরকারি বিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি থেকে বাংলা তথা মাতৃভাষায় পরিবর্তন করার কাজটি করেছিলেন। এতে বাংলায় শিক্ষার আলো প্রজ্বলিত হতে শুরু করলো। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ও ৮ আগস্ট কলকাতার এলবার্ট হলে নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক সকুল শিক্ষক সমিতির ২য় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সম্মেলনে সমিতির নাম স্কুলটি বাদ দিয়ে নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি নামকরণ করা হয়েছিলো। নামটি সমিতির গঠনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ হয়ে সোসাইটি রেজিষ্ট্রেশন অনুসারে নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয়। যার নম্বর ৯৩৪৯। প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয় সিরাজগঞ্জ শহরে। তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতার এলবার্ট হলে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বিচারপতি চারুচন্দ্র বিশ্বাস। উদ্বোধন করেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। সম্মেলনে অধ্যাপক মহীতোষ রায় চৌধুরীকে সভাপতি ও রাধিকা প্রসাদ বন্দোপাধ্যায়কে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি রয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গে। পূর্ব বাংলা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষকসমিতি নামে যাত্রা শুরু করে। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে পল্লী এলাকার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা আইন সংশোধন করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামুলক করার পরীক্ষামূলক ৫ হাজার বিদ্যালয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করেন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা ৪ বছর মেয়াদী ছিলো। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ৫ বছর মেয়াদ করা হয়।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ৫ হাজার স্কুল বাধ্যতামূলক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকরণ করা হয়। প্রাথমিকে সে সময় ৫ হাজার বিদ্যালয় মডেল ও বাকিগুলো সাধারণ বিদ্যালয় বিভক্ত করায় বৈষম্য সূত্রপাত হয়। মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের মডেল ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন ও তত্ত্বাবধায়ন করতে পারতেন। মডেল ছাড়া বিদালয়গুলোর শিক্ষক ও অভিভাবকদের মাঝে বৈষম্যের ফলে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিলো। যা বর্তমান প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের মাঝে বৈষম্য নিয়ে বৈরী মনোভাবের মতো। এ অসন্তোষ তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ও বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের সৃষ্ট। এখানে শিক্ষক নেতাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কতিপয় চামচা নেতা বৈষম্য নিরসনের পরিবর্তে চামচামিকে বেশি প্রধান্য দেয়।

প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি পদ অলংকৃত করেছিলেন প্রিন্সিপাল আজিম উদ্দীন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ ও অধাপক আবুল কালাম আযাদ। প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ সভাপতি ও জামালপুর জেলার আবদুর রহমান সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির রেজিস্ট্রেশন নেয়া হয়। যার নম্বর ১৮০৮/৭৫ (১৯৬২ -৬৩) । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর উক্ত রেজিষ্ট্রেশন বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি নামে স্বাভাবিকভাবে হয়ে যায়। অধ্যাপক আযাদের সময়ে রেজিষ্ট্রেশনের প্রতি নেতৃত্বের তেমন গুরুত্ব ছিলো না। যদিও সারাদেশের শতভাগ শিক্ষক বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ ছিলো।

অধ্যাপক আবুল কালাম আযাদ ও কাজী আ.কা ফজলুল হকের নেতৃত্বের শেষভাগে, আমিসহ তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আ.কা. ফজলুল হক, সাবেক নেতা নুরুল আজিম জামালপুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমানের বাড়িতে যাই। তার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে জানতে পারলাম রেজিষ্ট্রেশন জয়েন্ট স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে করা হয়েছে। তখনকার সময়ে পুরোনো রেজিষ্ট্রেনের কাগজপত্র অনেক টাকা পয়সা খরচ করেও সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়নি।

অবশেষে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১মে ঢাকার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে কাউন্সিল অধিবেশনে নুরুল আবছারকে সভাপতি ও আমাকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। দায়িত্ব গ্রহণ করার পর দীর্ঘ সময় রেজিষ্ট্রেশন কাগজ পত্রের সন্ধান পাইনি। অবশেষে গোপালগঞ্জ জেলায় সাংগঠনিক মিটিংয়ে রওনা দেয়ার দিন একবার রেজিস্ট্রেশনের কাগজপত্রের তল্লাসী দিলাম। আমার সামনে ধুলো-বালি মিশ্রিত একবারে অব্যবহৃত কাগজের মাঝে রেজিষ্ট্রেশনের পুরনো কপি বেরিয়ে এলো। দায়িত্ব থাকাকালীন প্রতিবছর কমিটি নবায়ন করা হয়েছিলো।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রয়ারি ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবে এক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি নামকরণ করা হয়। অধ্যাপক আবুল কালাম আযাদ সভাপতি নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদসহ শিক্ষকদের ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই থেকে জাতীয়করণ করা হয়। তখনকার সময়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্কেল ছিলো, ২২০ টাকা মূল বেতন । আর পেতেন বাড়ি ভাড়া। অন্য কোনো ভাতা ছিলো না। প্রধান শিক্ষকদের প্রায় ১ বছর পরে ১০ টাকা চার্জ অ্যালাউন্স বকেয়া দেয়া হয়।

প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণের কিছু সময় যেতে না যেতেই একটি ঘৃণ্যচক্র ষড়যন্ত্র শুরু করে। জারি করা হয় প্রাথমিক শিক্ষকদের থানা তথা বর্তমান উপজেলার বাইরে বদলির আদেশ। এ ষড়যন্ত্রমুলক আদেশ আদালতের রায়ের মাধ্যমে রুখে দেয় বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। প্রসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর বেতন স্কেল ঘোষণা করা হয়। সে বেতন স্কেল বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির আন্দোলনের মুখে প্রধান শিক্ষকদের ১০ টাকা চার্জ অ্যালাউন্স বাতিল করে, বেতন স্কেল ৩০০ টাকা থেকে ৩২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে সবচেয়ে বৃহৎ আন্দোলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮০-১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে। প্রথমে ঢাকা শহরকে মিউনিসিপ্যালটির অধীনে প্রাথমিক বিদ্যালয় হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে সারা দেশের প্রাথমিক শিক্ষা স্থানীয় সরকারের অধীনে দেয়া হয়। সে সময় প্রাথমিক শিক্ষকেরা বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নির্দেশ মোতাবেক দেড় লাখ শিক্ষক তাদের পরিবারের সদস্য নিয়ে প্রায় ৩ লাখ লোকের মহাবিক্ষোভ করছেন। এতো বৃহৎ জনবলের সমাবেশ ঢাকা শহরে কোনো পেশাজীবি সংগঠন আজও করতে পারেনি। সে সময় গুলিস্তান থেকে শহীদ মিনার প্রাথমিক শিক্ষক পরিবারের দখলে ছিল। যানবাহন বন্ধ ছিলো। পুরো ঢাকা শহর ছিলো প্রাথমিক শিক্ষক নগরী।

সম্মেলন ও আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের সময়ে বেতন স্কেল আদায়সহ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষকসমিতির অসংখ্য অর্জন। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে প্রাথমিক শিক্ষকদের বস্ত্রসংকট দূরীকরণে সমিতির উদ্যোগে টঙ্গীর অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলের শার্টের কাপড় কমদামে শিক্ষকদের মাঝে সরবরাহ করা হয়। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খাতা, পেন্সিল, দুধ, ছাতু বিনামূল্যে সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযুদ্ধে সকল পেশাজীবি সংগঠনের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষকদের সর্বাধিক অংশগ্রহণ, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ তথা সকল শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণ সার্ভিসবুক ছাপিয়ে শিক্ষকদের সমস্যা নিরসন করা, আদালতে রিট করে থানার বাইরে বদলি রোধ করা,প্রধান শিক্ষকদের ১০টাকা দায়িত্বভাতা বাতিল করে ৩২৫ টাকার স্কেলে উন্নীত করা।

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে ২০৫ খাতের নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রকল্পের মেয়াদ সমাপ্তিতে, তাদের চাকুরিচুত্যির ঘোষণা দিলেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার। এবারেও বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ঢাকা শহরে মহাবিক্ষোভের ডাক দেন। আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণার পরের দিন অধ্যাপক আযাদকে গ্রেফতার করা হয়। কর্মসূচিতে ঢাকায় শিক্ষকদের আসার ওপর চলে কঠোর চাকুরিচুত্যির হুঁশিয়ারি। শিক্ষকদের ভাড়া করা বাস, লঞ্চসহ যানবাহনের ওপরও বাধা আসে।

স্কুলে স্কুলে পৌছে দেয়া হয় সমাবেশে যোগদান করলে চাকরিচুত্যির হুঁশিয়ারির টেলিগ্রাম। সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল কাশেম ফজলুল হকের নেতৃত্বে দৈনিক বাংলা থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত রাস্তা প্রাথমিক শিক্ষকদের দখলে চলে যায়। আন্দোলনের গতি পুনরায় ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের মতো উত্তাল হবে ভেবে, তৎকালীন সরকার ২০৫ এর খাতের শিক্ষকদের রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করেন এবং পরের দিনই অধ্যাপক আযাদকে মুক্তি দেন। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য আন্দোলনে মুক্তাঙ্গনের অনশন কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত দাবি পূরণ সম্ভব হয়নি।

বিগত সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর সময়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের ব্র্যাকের অধীনে ন্যস্ত করার ষড়যন্ত্র, শিক্ষকদের আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা হয়। সে সময় সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি, প্রাথমিক বিদালয় শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্টের শিক্ষকদের সন্তানদের লেখাপড়া, চিকিৎসাসহ নানা সংকটে সহযোগিতা করা হয়।

কল্যাণ ট্রাস্টের কাজ গতিশীল করার জন্য একজন শিক্ষককে উপজেলা প্রতিনিধি মনোনয়ন দেয়া হয়। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব শেষ হওয়ার পূর্বলগ্নে সভাপতি নুরুল আবছার, ওয়াহিদুজ্জামান মিয়া, বি.এম. আসাদউল্লা বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি বিলুপ্ত করার অপচেষ্টারত থেকে আ.আউয়াল তালুকদারের নেতৃত্বে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণার প্রক্রিয়া করলেও শেষপর্যন্ত মো. সিদ্দিকুর রহমান, সুবল চন্দ্র পাল, আশরাফ উদ্দিন মোল্লা পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে সমিতি পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়।

বর্তমানে আদালতের মাধ্যমে প্রধানশিক্ষকদের ১০ম গ্রেড ২য় শ্রেণির মর্যাদা অর্জনের দাবি, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির এরশাদের সামরিক শাসনের প্রথমদিকের। বর্তমান সময়ের মতো উচ্চ শিক্ষিতের সমাহার ছিলো না বলে দাবিটি পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির একাউন্টে প্রায় ৪০ লাখ টাকা জমা রয়েছে। সমিতির অর্জন মীরপুরে ১০ কাঠা জমিতে শিক্ষক ভবন, যা বর্তমানে অবৈধ দখলে রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্টও শিক্ষক সমিতির নিয়ন্ত্রণে নেই। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি আজ ৫ অংশে বিভক্ত। সংগঠনের সম্পদসহ শিক্ষকদের সমস্যা নিরসনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দরকার।

লেখক – শিক্ষাবিদ

#প্রাথমিক বিদ্যালয় #শিক্ষক