ছবি : সংগৃহীত
সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ সংশোধন করে শাস্তির বিধান আরও কঠোর করে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করা হয়েছে। এ নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া দৈনিক যুগান্তরে একটি মতামত লিখেছেন।
তিনি বলেছেন, সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধান সংবলিত ৩৭ক ধারা সংযোজন করে ২৫ মে সরকারি চাকরি আইনের সংশোধনী গেজেট জারি ও কার্যকর করা হয়েছে। অতীতে কর্মচারীরা থ্রি নট থ্রি, পিও নাইন, এমএলও নাইন এবং স্পেশাল প্রভিশন সেভেনটি নাইনের মতো কালাকালুনের মুখোমুখি হয়েছে। এখন কর্মচারীরা ওইসব কালাকালুনের চেয়েও আতঙ্কজনক আইনের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।
কারণ সংযোজিত ধারাটি সরকারি চাকরি আইনের অধীন কর্মচারীদের জন্য গিলোটিনের মতো কাজ করবে। ইতিহাসে এ দিনটিকে কর্মচারীরা কালো দিবস হিসাবে মনে রাখবে, এটা তো কাম্য হতে পারে না। তাই প্রয়োগ করার আগে সরকারের উচিত আইনটি আরও ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করা।কর্মচারীদের বিভিন্ন গ্রুপ ও গোষ্ঠী আন্দোলনের মাধ্যমে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে এবং জনসেবা ব্যাহত করে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলে দাবি আদায়ে এতটাই তৎপর হয়ে উঠেছে যে, সরকারের কাছে কঠোর অবস্থান নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ এরূপ আন্দোলন নিরসনের জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়, তার অভাব বর্তমান প্রশাসনে প্রকট। এরূপ অবস্থায় জনদুর্ভোগ বন্ধ করা এবং জনসেবা অব্যাহত রাখার জন্য প্রশাসনিক দুর্বল ব্যবস্থায় সরকারের পক্ষে কঠোর আইনের আশ্রয় নেওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কঠোর আইনের নামে নিবর্তনমূলক এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইন কারও কাছে কাম্য নয়। এছাড়া সংশোধনী অধ্যাদেশটির গঠন ও ভাষা প্রয়োগের দুর্বলতার কারণে আইনটির ব্যাপক অপপ্রয়োগের আশঙ্কা রয়েছে।
আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও আইনকে ব্যাখার জন্য আইনের উদ্দেশ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার উদ্দেশ্য ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের বিশেষ বিধানে উল্লেখ ছিল। কিন্তু বর্তমান সংশোধনী অধ্যাদেশটি কী উদ্দেশ্যে সরকার জারি করছে, এর উল্লেখ করা হয়নি। ফলে জনদুর্ভোগ, জনসেবায় বিঘ্ন ঘটানো বা জনসেবা ব্যাহত করা বা আন্দোলন ছাড়াও সাধারণ কারণেও এর অপপ্রয়োগের আশঙ্কা রয়েছে, যা কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করতে পারে। এরূপ হলে সমগ্র জনপ্রশাসনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। কেননা আতঙ্কগ্রস্ত কোনো কর্মচারীর কাছ থেকে স্বাভাবিক কার্যক্রম আশা করা যায় না।১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের বিশেষ বিধান কেবল সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু জারিকৃত অধ্যাদেশের বিধান সরকারি চাকরি আইনের আওতাভুক্ত সব কর্মচারী তথা বিধিবদ্ধ সংস্থা ও কোম্পানির কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য করে এর প্রয়োগ পরিধি আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের বিশেষ বিধানে কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি, শৃঙ্খলা বিনষ্টকারী ও কর্তব্য সম্পাদনে বাধা সৃষ্টিকারী কার্যকলাপ এবং একা বা অন্যদের সঙ্গে একত্রে কর্ম হতে অনুপস্থিত থাকা, কর্মে বিরত থাকা ও কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হওয়া এবং অন্য কর্মচারীদের কর্মে অনুপস্থিত থাকতে, কর্মে বিরত থাকতে বা কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেওয়া বা প্ররোচিত করা এবং অন্য কর্মচারীদের কর্মে উপস্থিত হতে, কর্ম করতে বাধা দেওয়াকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল।
অপরদিকে সংশোধনী অধ্যাদেশে অনানুগত্যের (insubordination) শামিল কোনো কাজ করা, শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করা, কর্তব্য সম্পাদনে বাধা সৃষ্টি করা, কর্মে অনুপস্থিত থাকা, কোনো কর্মচারীকে কর্মে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা কর্তব্য পালন না করার উসকানি দেওয়া বা প্ররোচিত করা, কোনো কর্মচারীকে কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করাকে অসদাচরণ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের বিশেষ বিধানে অন্য কর্মচারীদের মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করলেই তা কেবল অপরাধ হতো। কোনো কর্তৃপক্ষের ব্যক্তিগত অনানুগত্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হতো না। কিন্তু সংশোধনী অধ্যাদেশের ভাষাগত কারণে কোনো কর্তৃপক্ষের ব্যক্তিগত অনানুগত্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। এছাড়া অনানুগত্যের শামিল কাজ কী, তা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেবে এবং এর অপপ্রয়োগের আশঙ্কা অনেক বেশি। এছাড়া এই অনানুগত্য কার প্রতি, কোনো দুর্নীতিপরায়ণ কর্তৃপক্ষের প্রতি, নাকি সরকারের প্রতি? কোনো কোনো কর্তৃপক্ষ তার ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এটি ব্যবহার করতে পারবে। তার অনুচিত ও বিধিবহির্ভূত কাজে সহযোগিতা না করলেই অধীনস্থকে দণ্ড দিয়ে চাকরি থেকে বিদায়ও করতে পারবে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী ই-মেইলে নোটিশ জারি করা হলেও তা যথাযথভাবে জারি হয়েছে বলে গণ্য হবে। এই বিধান দ্বারা অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। বিভিন্ন কারণে অভিযুক্তের ই-মেইলে অ্যাক্সেস না থাকতে পারে এবং নোটিশ প্রিন্ট করারও সুযোগ না থাকতে পারে, কোনো কারণে ই-মেইলে নাও দেখা হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে কি তাকে যথাযথ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হলো?অধ্যাদেশটির সবচেয়ে বড় ক্রটি হলো, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অধস্তন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি তথা অভিযোগ গঠনকারী ব্যক্তিকে জবাব বিবেচনা করে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষমতা প্রদান, যা সরাসরি সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদের দফা(১)-এর বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের এ বিধানমতে, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা অধস্তন কোনো কর্তৃপক্ষের দ্বারা কোনো কর্মচারীকে বরখাস্ত বা অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাবে না। যে অধস্তন কর্তৃপক্ষের বরখাস্ত বা অপসারিত বা পদাবনমিত করার ক্ষমতা নেই, সেই অধস্তন কর্তৃপক্ষ কীভাবে অভিযুক্ত দোষী কী নির্দোষ তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাখে?
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের বিশেষ বিধানে কেবল অভিযোগ প্রণয়ন ও জারির ক্ষমতা ছিল ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের এবং জবাব বিবেচনা, শুনানি গ্রহণ ও দোষী কী নির্দোষ সাব্যস্ত করার ক্ষমতা ছিল কেবল নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের। সংবিধানের বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এ বিধান প্রভাবমুক্ত বিচারব্যবস্থায় টিকবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।