শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়ের। ছবি : সংগৃহীত
শিক্ষাসচিব সিদ্দিক জোবায়ের-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে থেকেও এবার (২০২৫ শিক্ষাবর্ষ) কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থীকে নিম্নমানের পাঠ্যবই পড়তে দিতে হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে আজ বুধবার (৪ জুন) প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সিদ্দিক জোবায়ের। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার এর উপস্থিতিতে সিদ্দিক জোবায়ের সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, আগামী শিক্ষাবর্ষের নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার কোনো সুযোগ থাকছে না। আমরা আশাকরি ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে আর নিম্নমানের কোনো বই থাকবে না।
বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে মতবিনিময় সভায় তিনি এমন ঘোষণা দেন। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর তিনি দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ পান। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুতমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর পিএস ছিলেন প্রায় ছয় বছর।
প্রতিবছরই কমবেশি নিম্নমানের পাঠ্যবই গছিয়ে দেওয়া হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। গত বছর ডিসেম্বর মাসে মন্ত্রণালয়ের নিজের অফিস ছেড়ে বেশিরভাগ সময় মতিঝিলের এনসিটিবি অফিসে কাজের তদারকি করেছেন সিদ্দিক জোবায়ের। তার সঙ্গে সরাসরি যোগসূত্র তৈরি হয়েছে পুস্তক ও কাগজ ব্যবসায়ীদের। যাদের অধিকাংশই আওয়ামীপন্থী।
সিদ্দিক জোবায়ের-এর পদত্যাগের দাবিতে গত কয়েকমাসে একাধিক শিক্ষক সংগঠন মিছিল-সমাবেশ করেছে।
এদিকে, পাঠ্যবই প্রকাশর ও বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীনে ছাপানো পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত এনসিটিবির দরপত্রে বইয়ের উজ্জ্বলতার জন্য নির্দিষ্ট মান থাকলেও অনেক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সেটি অনুসরণ করেনি। এসব বই বাঁধাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের গাম। পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠা সংখ্যার ক্ষেত্রেও করা হয়েছে নয়ছয়। এমন অনিয়ম, অসঙ্গতিতে ভরা অন্তত ৩৩ শতাংশ নিম্নমানের বই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত হিসাবে দেখা যায়, ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে ১৩ কোটি বইয়ের মানই খারাপ। এসব বই ছাপিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা বিলের নামে তুলে নেওয়া হয়েছে। আবার অনেক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান যথাসময়ে বই সরবরাহ করেনি। এতে শিক্ষার্থীরা বেশ ভালোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সূত্র জানায়, কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান, এনসিটিবি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বই নিয়ে এমন অনিয়ম করা হয়েছে। ৩০টির বেশি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এনসিটিবির জানায় এবার খারাপ বই ছাপানোর কারণে ২০টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা দরপত্রের মান ঠিক রেখে আবার শিক্ষার্থীদের বই রিপ্লেস করবে। যদি সেটি সম্ভব না হয়, তাদের অর্থদণ্ড করা হবে। এরপরও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এনসিটিবি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত ছিল। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে বিনামূল্যে বই ছাপাতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে।
যেভাবে প্রকাশ পেল নিম্নমানের বইয়ের তথ্য : গোয়েন্দা নজরদারি ছিলো কঠোর। এছাড়া এনসিটিবি বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৩২টি টিম ৬৪ জেলায় মাঠপর্যায়ে পাঠানো হয়। টিমগুলো প্রতিটি জেলার একটি উপজেলা থেকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে বই সংগ্রহ করে। এরই মধ্যে ৪৭টি জেলার বই সংগ্রহ করা হয়েছে। যার মধ্যে ৩৩ শতাংশ বই নিম্নমানের হিসাবে দেখতে পেয়েছেন টিমের সদস্যরা। প্রাপ্ত হিসাবে ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে ১৩ কোটি বই নিম্নমানের।
এছাড়া বইয়ের মান যাচাই করতে হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইনস্পেকশন সার্ভিস নামে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপার পরের মান যাচাইয়ের জন্য নিয়োগ দেয় এনসিটিবি। ওই প্রতিষ্ঠানটিও মাঠপর্যায় থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করেছে। তাদের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে দৈবভাবে সংগ্রহ করা ৩ লাখ ১৯ হাজার নিম্নমানের বইয়ের মধ্যে ২০ শতাংশ বই নিম্নমানের। অক্সফোর্ড প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন ইবতেদায়ি ৩য় শ্রেণির বিজ্ঞান বইটি নিম্নমানের। দরপত্রের নির্ধারিত মান অনুযায়ী কাগজের মান ৮০ জিএসএমের পরিবর্তে এতে ৭৩ জিএসএম ব্যবহার করা হয়েছে। রেদওয়ানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন ভোকেশনাল ৯ম শ্রেণির জেনারেল মেকানিক্স বইয়ে ৭০ জিএসএমের পরিবর্তে ৬৫ জিএসএম কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে আরও জানা যায়, অনুপম প্রিন্টার্স মাধ্যমিকের নবম শ্রেণির রসায়ন বইয়ে ৭০ জিএসএমের পরিবর্তে মাত্র ৬১ জিএসএম কাগজ, শাফিন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন মাধ্যমিক ভোকেশনাল ৭ম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের মান ৭০ জিএসএমের পরিবর্তে অতি নিম্নমানের ৫৯ জিএসএম কাগজ, সুবর্ণা প্রিন্টার্স মাধ্যমিকের নবম শ্রেণির গণিত বইয়ের নির্ধারিত মান ৭০ জিএসএমের পরিবর্তে ৫৫ জিএসএম কাগজ, এ্যারিস্টোক্র্যাটস সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং দাখিল ৬ষ্ঠ শ্রেণির আকাইদ বইয়ের নির্ধারিত মান ৭০ জিএসএম পরিবর্তে ৫৬ জিএসএস কাগজ, লেটার এন কালার লি. ইবতেদায়ি ১ম, ২য় ও ৪র্থ শ্রেণির বইয়ের নির্ধারিত মান ৮০ জিএসএম পরিবর্তে ৭০ জিএসএম কাগজ, বর্ণমালা প্রেস মাধ্যমিকের নবম শ্রেণির ব্যবসায় উদ্যোগ বইয়ের নির্ধারিত মান ৭০ জিএসএম পরিবর্তে ৫৮ জিএসএম কাগজ, ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস দাখিল নবম শ্রেণির গণিত বইয়ের নির্ধারিত মান ৭০ জিএসএম পরিবর্তে ৬৩ জিএসএম ব্যবহার করা হয়েছে। বর্ণমালা নবম শ্রেণির জীববিজ্ঞান বইয়ের নির্ধারিত মান ৭০ জিএসএম পরিবর্তে ৬০ জিএসএম কাগজ, দোয়েল প্রিন্টার্স দাখিল ১০ম শ্রেণির উচ্চতর গণিত বইয়ের নির্ধারিত মান ৭০ জিএসএম পরিবর্তে সাড়ে ৬৫ জিএসএম কাগজ, দ্য গুডলাক ইবতেদায়ি ৪র্থ শ্রেণির কুরআন মজিদ ও তাজভিদ শিক্ষা বইয়ের নির্ধারিত মান ৮০ জিএসএম পরিবর্তে ৭১ জিএসএম কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। এসব নিম্নমানের বই ছাপানোর নেপথ্যে উৎপাদন ও বিতরণ শাখার কিছু কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও জানা গেছে।
জানা যায়, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক বিতরণের পর দেশের প্রতিটি উপজেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাব পরীক্ষা করা হয়। পর্যালোচনায় প্রায় ২০ শতাংশ বইয়ের গুণগত মান নিম্নমানের পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে জিএসএম (গ্রাম পার স্কয়ার মিটার) নির্দেশনা মানা হয়নি এমন ২০টি প্রিন্টার্সের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগপত্র নমুনা কপিসহ এনসিটিবিতে জমা দিয়েছে ইন্সেপেকশন সংস্থা।
দৈনিক শিক্ষার প্রতিনিধিদের পাঠানোে তথ্যে দেখা যায়, রাঙামাটির বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা বেশিরভাগ বই নিম্নমানের কাগজের। এতে দেখা যায়, কাশেম অ্যান্ড রহমান প্রিন্টিং প্রেসের নবম-দশম শ্রেণির গণিত বইয়ে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে ৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সরেজমিন তথ্য সরবরাহ করা হয়। দেখা যায়, প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবকটি পাঠ্যবই মুদ্রণে ৮০ গ্রামের কাগজের পরিবর্তে ৬০ গ্রাম (ড্যাম) কাগজে বই ছাপানো হয়েছে। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য আমার বাংলা বই, ইংলিশ ফর টুডে, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, প্রাথমিক গণিত বইগুলো ৬০ গ্রামের (ড্যাম) কাগজে ছাপানো হয়। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান এসএস প্রিন্টার্স বইগুলো ছাপিয়েছে। অন্যদিকে ১ম শ্রেণির আমার বাংলা বই, দ্বিতীয় শ্রেণির ইংলিশ ফর টুডে, গণিত, তৃতীয় শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় পাঠ্যবইগুলো শাপলা প্রিন্টার্স এবং পঞ্চম শ্রেণির বইগুলো অগ্রণী প্রিন্টার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠান ছাপিয়েছে। এছাড়া মাধ্যমিকের জন্য যথাক্রমে, চারুপাট, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, বিজ্ঞান, শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, ইংলিশ ফর টুডে, কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা, গণিত, কৃষি শিক্ষা, আনন্দ পাঠ, চারু ও কারুকলা, বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ও ইসলাম শিক্ষাসহ সৃষ্ট ১৪টি পদের বই ছাপিয়েছে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান অনন্য প্রিন্টার্স। সব বইতেই নিম্নমানের ৬০ গ্রামের ড্যাম কাগজ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির জন্য ছাপানো বইগুলোতেও ৬০ গ্রামের নিম্নমানের ড্যাম কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে।