শিক্ষকদের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করার পাঁয়তারা! | মতামত নিউজ

শিক্ষকদের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করার পাঁয়তারা!

হঠাৎ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কর্ণধারদের কি হয়েছে যে, তারা ২০ গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত পিয়ন ও ১৬ গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত কেরানিদের প্রমোশন বাণিজ্যের মাধ্যমে ১০ গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক, ৮ গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং ৭ গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বস হিসেবে প্রমোশন দিয়ে সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার করার পাঁয়তারা করছেন?

#মাছুম বিল্লাহ #শিক্ষক #সহকারী শিক্ষক #মর্যাদা

আমরা ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ নামক কবিতাটি স্কুলজীবনে অনেকেই কিংবা সবাই পড়ে এসেছি। কাজী কাদের নেওয়াজের খুবই সুন্দর ও শিক্ষনীয় সেই কবিতা আজ ভুল প্রমাণিত হতে চলেছে। শিক্ষকের মর্যাদা বিষয়ক ইউনেস্কো ও আইএলও সনদ গৃহীত হয় ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে। এর আগে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে মেক্সিকো সিটিতে, ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ‘শিক্ষকতার মর্যাদা’ শীর্ষক বিভিন্ন সেমিনার ও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনোমিক এবং সোশ্যাল রিচার্স’ ৩৫টি দেশের ৩৫ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে ‘শিক্ষকের মর্যাদা সূচক’ প্রকাশ করে।

ওই সূচক সম্পর্কে ভার্কি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সানি ভার্কি বলেন, যেসব সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা বেশি, সেখানে শিক্ষার্থীরা ভালো শিক্ষা পান। শিক্ষকের মর্যাদা সামাজিক সূচকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ চীন এবং সবচেয়ে খারাপ সূচকে এগিয়ে থাকা দেশ ইসরায়েল। যার প্রভাব মুসলিম বিশ্ব ফিলিস্তিনে তাকিয়ে দেখছে খারাপ শিক্ষার প্রভাব কতটা ভয়ানক!

হঠাৎ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কর্ণধারদের কি হয়েছে যে, তারা ১৩, ১৪, ১৬ ও ২০তম গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত কমিউটার অপারেটর, অফিস সহকারী, এমএলএসএসদের প্রমোশন বাণিজ্যের মাধ্যমে ১০ম গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক, ৮ম গ্রেডের সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং ৭ম গ্রেডের প্রধান শিক্ষকের বস হিসেবে প্রমোশন দিয়ে সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার করার পাঁয়তারা করছেন? অফিসার হতে চাওয়াদের এদের একটা বড় অংশ আবার উপবৃত্তি প্রকল্পে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োজিত ছিলেন, কেউ কেউ বেসরকারি থেকে আত্তীকৃত।

শোনা যাচেছ, ইতোমধ্যে এই সব পিয়ন ও কেরানি শতকোটি টাকা খরচ করে নিজেদের পদোন্নতি আর শিক্ষকদের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করার চূড়ান্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছেন। মাউশি অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) মো. শাহজাহান সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতির জন্য তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। তার এত তাড়াহুড়ার রহস্য শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের বুঝতে কষ্ট হচেছ।

শিক্ষকদের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করার পাঁয়তারা!

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বঞ্ছনার শেষ নেই। যেনতেন কারণে তারা লাঞ্ছিত হন। বেতন ভাতা পেতেও পোহাতে হয় যন্ত্রণা। এখন এর সাথে যোগ হতে যাচেছ ২০ গ্রেডের এমআই এসএস/পদের খবরদারি। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে এমনকি শিক্ষা অধিদপ্তরে এসেও এইসব কর্মচারীর হাতে বেসরকারি শিক্ষকদের অনেক লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে এবং হচেছ। অনুমোদনবিহীন ভূঁইফোড় বেসরকারি বিএড কলেজ থেকে এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে সার্টিফিকেট জোগাড় করেছেন এইসব কর্মচারী। ওইসব কাগজসর্বস্ব সার্টিফিকেটের বদৌলতে তারা পদোন্নতির মাধ্যমে উপজেলা শিক্ষা অফিসার হয়ে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের ওপর মাতব্বরি করবেন।

বিষয়টি অন্ত:চক্ষু দিয়ে একবার ভাবলে এর মারাত্মক নেগেটিভ প্রভাব যা গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে শিকেয় তোলার অবস্থায় নিয়ে যাবে। অথচ সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকরা পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। বেসরকারি হাইস্কুলের শিক্ষকরা এখন নিয়োগপ্রাপ্ত হন এনটিআরসিএর মাধ্যমে। অর্থাৎ আগের সে অবস্থায় নেই যে, কমিটি টাকার বিনিময়ে যাকে তাকে নিয়োগ দিয়ে দিচেছ। এখন অনেক মানসম্পন্ন শিক্ষক বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আসছেন। এটি শিক্ষা উন্নয়নের একটি শুভ সূচনা। যে অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কথা আমরা শুনতে পাচিছ সেটি এই মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কুঠারাঘাত করতে যাচেছ।

বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। শিক্ষা উপদেষ্টা নিজেও একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক। এখন দেখার অপেক্ষা কিভাবে ২০ গ্রেড থেকে ৩টি প্রমোশন বাগিয়ে ৭ গ্রেডের প্রধান শিক্ষককে পরিচালনা করেন পিয়ন, যাদের সার্টিফিকেট অনেকটাই ভূয়া।

মাননীয় শিক্ষকদের কোনোভাবেই অপমানিত করা যাবেনা। এসব আজগুবি পদক্ষেপ কেন শিক্ষাক্ষেত্রে? এখানে সমস্যার অন্ত নেই, শিক্ষকদের পদমর্যাদা, আত্মমর্যাদা, সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক প্রণোদনা বৃদ্ধিসহ বহু কিছু করার রয়েছে, তা না হলে শিক্ষকতায় মেধাবীরা আসবেন না। এখনই আসতে চাননা, যারা এসেছেন তাদের অনেকেই চলে যাচেছন এবং যারা আছেন তারাও পেশায় মনোনিবেশ করতে পারেন না। কারণ বেসরকারি বিদ্যালয় কমিটিতে থাকা অশিক্ষিত ও অর্ধ-শিক্ষিতদের আচরণ। সেই অবস্থা যখন একটু একটু বদলাতে শুরু করেছে, এনটিআরসিএ-এর মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক প্রক্রিয়া সেই ২০০৫ থেকে শুরু হয়ে এ পর্যন্ত একটি ভাল অবস্থানে যাওয়ার অপেক্ষায় গোটা শিক্ষক সমাজ ও জাতি, সেই সময়ে এ কেমন সিদ্ধান্ত?

শিক্ষকরা শুধু অর্থ চাননা, তাদের মর্যাদার বিষয়টি সবার ওপরে। এটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে, ঠিক করতেই হবে। এসব নিয়ে যখন শিক্ষাঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা চলছে, সেই মুহূর্তে এসব চিন্তা কোথা থেকে আসছে, কেন আসছে তা আমাদের বুঝে আসেনা।

এই অবস্থা শিক্ষকদের আরও অপমানজনক অবস্থার মধ্যে ফেলে দেবে। শিক্ষকতার ধারেকাছেও আসতে চেইবেন না প্রকৃত মেধাবীরা। আর মেধাবীরা শিক্ষকতায় না এলে একটি জাতি যে করুণ দুর্দশার মধ্যে পড়ে যায় তার ভুরি ভুরি উদাহরণ পৃথিবীতে রয়েছে। আমাদের দেশেও আমরা তার ফল প্রত্যক্ষ করছি।

নতুন এই সিদ্ধান্ত শিক্ষক সমাজকে যে অবমাননাকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেবে সেটি আমরা কেউ-ই চাইনা। সরকারেরও চাওয়া উচিত নয়। যাদের কথা চিন্তা-ভাবনা করা হচেছ তাদের যদি অর্থনৈতিক কোনো প্রণোদনা দিতে হয় কিংবা প্রমোশন দিতেই হয়, সেটি এখানে কেন? এভাবে কেন? তাদের মধ্যে যারা প্রকৃত মেধাবী, আচার-আচরণ ভাল এবং চাকরির রেকর্ড পজিটিভ তাদেরকে হয়তো সঠিক বাছাই পর্বের মধ্যে দিয়ে অর্থাৎ পিএসসি ফেস করে আসার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তা’ হলে প্রশ্ন খুব একটা থাকবেনা। কিন্তু প্রমোশন কেন? তারা কি শিক্ষক? তারা কি শ্রেণিকক্ষে ভবিষ্যত বংশধরদের শিক্ষাদান করেছেন? তারা কি শিক্ষার গ্রামার জানেন? চাইল্ড সাইকোলজি জানেন? ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট প্রত্যক্ষভাবে জানেন? এসব বিষয়ে তাদের প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

তাহলে তারা কিভাবে শিক্ষার বস হবেন? যারা এসব বিষয় নিয়ে বছরের পর বছর পরিশ্রম করছেন তাদের ওপরে লাঠি ঘুরানোর জন্য এসব অবাস্তব ধারণা ও সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। এটি শিক্ষার কোনো কল্যাণে কাজ করবে না বরং ধস তরান্বিত করবে, যেটি আমাদের জাতীয় স্বার্থে কোনোভাবেই হতে দেয়া উচিত নয়।

লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক

#মাছুম বিল্লাহ #শিক্ষক #সহকারী শিক্ষক #মর্যাদা