অভিনব চালাকি করে তিন বিতর্কিত ছাপাখানাকে প্রাক-প্রাথমিকের বই ও খাতা ছাপার কাজ দেওয়ার সব আয়োজন চূড়ান্ত করার পথে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
ইতিমধ্যে কায়দা করে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। মেশিনের সাইজের এমন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে যাতে সারাদেশে মাত্র দুই/তিনটি প্রতিষ্ঠানই বই ছাপার কাজ পায়।
পুরো প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য খেলোয়াড় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের হর্তকর্তা দীপু মনি সিন্ডিকেটের সক্রিয় দুই চৌধুরী।
শিক্ষা ক্যাডারের দুই চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত ১২ বছরে পরীক্ষা সংস্কার ও বইখাতে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ছাড়াও দেশের গোটা পাবলিক পরীক্ষা ব্যবস্থা ধবংসের অভিযোগ রয়েছে।
সুচতুর চৌধুরীরা পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে নবাগত ও আওয়ামী বিরোধী কয়েকজন কর্মকর্তাকে ব্যস্ত রেখেছেন অন্যান্য মামুলি বিষয়ে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। দুএকজন কি যে বোঝেননি তা-ও বোঝেননি। এরই ফাঁকে প্রাক-প্রাথমিকের প্রায় দেড় কোটি কপি বই ছাপার প্রায় দেড়শ কোটি টাকার কাজ দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার পথে অনেকদুর এগিয়েছে। মেশিনের সাইজের মারপ্যাঁচে এই অপকর্মটি করা হয়েছে। ঘুষ লেনদেন হয়েছে সাড়ে তিনকোটির মতো।
তিন প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপার কাজ দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিতর্কিত একজন বড় আমলার অনুমোদনও পাওয়া গেছে! যদিও বইয়ের কাজে আমলার এমন তদবির অনেকটা নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেছেন প্রকাশনা খাতের অনেকেই।
সব মিলে এনসিটিসহ শিক্ষা প্রশাসনে তোলপাড় চলছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে মতামত জানার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরীর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাকে অফিসেও পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তিন মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাস্টার সিমেক্স একটি। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর রাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও কয়েকজন সমন্বয়ক অভিযান চালিয়েছে গাজীপুরের মাস্টার সিমেক্সের গোডাউনে। জব্দ করেছে পাঠ্যবই ছাপার আর্ট কার্ড। তারা বলছেন, পাঠ্যবই ছাপার কাগজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কোটি কোটি শিক্ষার্থী ও সরকারকে জিম্মি করে রেখেছিল একটা সিন্ডিকেট। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর ‘রাতের অভিযানে মাস্টার সিমেক্সের গোডাউন থেকে পাঠ্যবইয়ের বিপুল কাগজ জব্দ’ শিরোনামে দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ ভিডিওসহ খবর প্রচারিত হয়। এতে বলা হয়, এই কাগজগুলো মূলত বিদেশ থেকে আমদানি করা। এগুলো দিয়ে পাঠ্যবইয়ের কভার পৃষ্ঠা করা হয়। মাস্টার সিমেক্স পেপারস লিমিটেড প্রতিবছর এই কাগজ এনে মজুদ করে। তারপর বই ছাপার সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। তারপর বেশি দামে বিক্রি করে সরকারের কাছে। একজন কর্মকর্তা বলেন, মাস্টার সিমেক্স এবারও বই ছাপার কাজ পেয়েছে। ছাপার জন্য তাদের যত কাগজ দরকার তার চাইতে ঢের বেশি কাগজ মজুদ করে রেখেছিল অধিক মুনাফার আশায়।
এছাড়া প্রিন্ট মাস্টার প্রিন্টার্সের বিরুদ্ধে রয়েছে গত ৭/৮ বছরে বিসিএসর পরীক্ষার খাতা সরবরাহে, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় খাতা সরবরাহ, প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের ফল প্রস্তুত ও আমাদানীকৃত কাগজের সিন্ডিকেট করার অভিযোগ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এনসিটিবির কয়েজন কর্মকর্তা তিনটি প্রতিষ্ঠানের সাথে আঁতাত করে মেশিনের নতুন সাইজের শর্ত আরোপ করেন। আগামী ১৭ জুন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
অভিযুক্ত ছাপাখানার মধ্যে মাস্টার সিমেক্স প্রিন্টিং প্রেস একটি। যার মালিক ডিবির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুনের দাপট ও ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও এই তথ্য্য উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে, মাস্টার সিমেক্স দাবি করেছে পুলিশ অফিসার হারুন তাদের কোম্পানির মালিক নন।
প্রিন্ট মাস্টার প্রিন্টিং প্রেসের মালিক পলাতক সাবেক চিপ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরী লিটন (লিটন চৌধুরী) এর ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত। গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও এই তথ্য্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রিন্ট মাস্টারও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
অপর প্রতিষ্ঠানটি কাজ নিলেও তারা তা না ছেপে অন্যদের আউটেসোর্সিং করে দেয়।