বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শিল্পগুরু সফিউদ্দিন আহমেদের আজ মৃত্যুর্বার্ষিকী। তাকে বাংলাদেশের আধুনিক ছাপচিত্রের জনক বলা হয়।
তবে ছাপচিত্রের পাশাপাশি তিনি জল রঙ এবং তেল রঙ-এর কাজেও দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি সাত দশকের বেশি সময় ধরে শিল্পচর্চায় দেশের চারুকলার জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন।
সফিউদ্দিন ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন কলকাতার ভবানীপুরস্থ নন্দন রোডে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে এখান থেকে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাজ্যের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস্ থেকে এচিং ও এনগ্রেভিংয় বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ ভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি দেশে-বিদেশে বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। চল্লিশের দশকে কলকাতার আর্ট কলেজে পড়ার সময়ে তিনি ছাপচিত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। তার কিছু অসাধারণ কাজের মাধ্যমে তিনি ভারতের কলারসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বাংলাদেশের শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, আবুল বারক আলভী, ফরিদা জামান, আবুল খায়ের, সুবীর চৌধুরী সফিউদ্দিন আহমেদের কাজের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
দুই বাংলার রঙ তার কাছে ছিলো ভিন্ন। তাই পশ্চিম বাংলার প্রকৃতির ধূসরতা এবং বাংলাদেশে নীলাভ সবুজের ছড়াছড়িকে মিশিয়ে নিয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে তার কাজে পরিস্ফুটিত হয় লোকশিল্পের বৈশিষ্ট্য। কালো রঙের প্রতি দুর্বলতা ছিলো তার, তাই কালো রঙের অনুশীলনের জন্যে ত্রিশ-চল্লিশের দশকেই শিয়ালদা স্টেশনে গেছেন রাতের বেলার কালো রঙ দেখতে।
যুক্তরাজ্যে তিনি কালোর বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার করেন এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে। নব্বইয়ের দশকে তিন বছরের মতো সময়ে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে রেখাচিত্র আঁকেন যা ‘ব্ল্যাক সিরিজ’ বা ‘কালো চিত্রমালা’ নামে পরিচিত। তার শিল্পকর্মে বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ছবি উঠে এসেছে বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে। তার কলকাতায় আঁকা ছবিতে এসেছে মহানগরের বস্তিজীবন, বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলের নিসর্গ, দুমকার প্রকৃতি ও সাঁওতাল-জীবন এবং ঢাকায় আঁকা ছবিতে বিষয়বস্তু হিসেবে এসেছে বন্যা, জাল, মাছ, নৌকা, ঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি নানা শ্রমজীবী মানুষ।
তিনি শিল্পী জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে ও অন্যান্য শিল্পীরা মিলে একসঙ্গে ঢাকা আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা চারুকলা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত।
তিনি ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা একাডেমি অব ফাইন আর্ট প্রদত্ত একাডেমি প্রেসিডেন্ট পদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি অর্জন করেন ভারতের পার্টনার শিল্পকলা পরিষদের দেয়া ‘দ্বারভাঙ্গা মহারাজার স্বর্ণপদক’, পাকিস্তান সরকারের দেয়া ‘প্রেসিডেন্ট পদক’, বাংলাদেশ সরকারের দেয়া ‘একুশে পদক’ এবং ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে ছাপচিত্র বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ জুন প্রচারবিমুখ এই গুণী শিল্পীর প্রথম একক প্রদর্শনী ‘রেখার অশেষ আলো’ অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে যা উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। শিল্পীর ছাত্র শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘তার চিত্রকর্ম সম্পর্কে আমার বলার কিছু নেই, ধৃষ্টতাও নেই। তার চিত্রকর্মের যে বিশালতা, বলিষ্ঠতা ও ব্যাপকতা এবং ড্রইংয়ে রংয়ের প্রলেপ, যেভাবে লাইন টেনেছেন তা শুধু অনুধাবন করার বিষয়। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে শিল্পগুরু সফিউদ্দীন মৃত্যুবরণ করেন।