শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে উল্লাস পাল এবার প্রশাসন ক্যাডার | বিসিএস নিউজ

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে উল্লাস পাল এবার প্রশাসন ক্যাডার

সাফল্য পেতে চাইলে নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এতে আপনার লক্ষ্য পূরণে সহায়তা হবে। পৃথিবীতে যারাই সফল হয়েছেন তাদের সবার জীবনই ছিল নানারকম বাধা আর বিপত্তি ঘেরা৷ তবে তারা থেমে যাননি বলেই হয়েছেন অন্যের কাছে অনুকরণীয়। এমনি এক স্বপ্নবাজ তরুণ শরীয়তপুরের উল্লাস পাল।

#৪৪তম বিসিএস #প্রশাসন ক্যাডার

সাফল্য পেতে চাইলে নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এতে আপনার লক্ষ্য পূরণে সহায়তা হবে। পৃথিবীতে যারাই সফল হয়েছেন তাদের সবার জীবনই ছিল নানারকম বাধা আর বিপত্তি ঘেরা৷ তবে তারা থেমে যাননি বলেই হয়েছেন অন্যের কাছে অনুকরণীয়। এমনি এক স্বপ্নবাজ তরুণ শরীয়তপুরের উল্লাস পাল।

শারীরিকভাবে সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি তাকে। পরিবারের সহযোগিতা আর কঠিন অধ্যবসায় তাকে নিয়ে গেছে সাফল্যে। অন্য সাধারণ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর অবশেষে ৪৪তম বিসিএসে তার পছন্দের প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছেন এই জীবনযোদ্ধা। তার এই গল্প অনুকরণের জন্য এক সফল উদাহরণ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উল্লাস পালের বাড়ি ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্তিকপুর এলাকায়। মৃৎশিল্পী উত্তম কুমার পাল ও আন্না রানীর তিন সন্তানের মধ্যে বড় তিনি। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় শিশু বয়স থেকেই স্বাভাবিকভাবে হাঁটা শেখা হয়ে ওঠেনি তার। জন্মগতভাবে দুই হাত ও দুই পা বাঁকা হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় হাঁটা শুরু করেন উল্লাস। এরপর তার মা-বাবা তাকে সুস্থ করতে ভারতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার করান। সেখানে তার ডান পায়ে একটি অস্ত্রোপচার করা হলে ধীরে ধীরে নিজে নিজেই হাঁটা শুরু করেন। তবে সেটা স্বাভাবিক হাঁটাচলা ছিল না।

ছোটবেলা থেকে ভীষণ মেধাবী ছিলেন উল্লাস। তার প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয় নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বাড়ির পাশের কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। বর্ষার দিনে তার যাতায়াত ভীষণ কষ্ট হওয়ায় বাবা উত্তম পাল সব সময় স্কুলে দিয়ে আসতেন। এছাড়াও তিনি বাম হাত দিয়ে লিখতেন। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলা দারুণ পছন্দ করতেন উল্লাস। সহপাঠীরা যখন খেলতো তখন দর্শক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় তেমন খেলার সুযোগ পাননি।

প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন উল্লাস। এরপর তিনি চলে যান ঢাকায়। তার ভীষণ ইচ্ছে ছিল ঢাকা কলেজে পড়ার, তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য সেখানে পড়াশোনার সুযোগ হয়নি। সবশেষে ঢাকা নর্দান কলেজ থেকে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে বিবিএ ও পরবর্তীতে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করেন। এরপর শুরু হয় তার চাকরি জীবনের দৌড়ঝাঁপ। অনেকগুলো চাকরির পরীক্ষা দিতে হয়েছে তার। একই সঙ্গে বিসিএস পরীক্ষার প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করেন তিনি। ৪০তম বিসিএস ও ৪১তম বিসিএসেও মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। ৪০তম বিসিএসে পাস করলেও ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কোনো পদেই সুপারিশ পাননি। তবে ৪১তম বিসিএসে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে সুপারিশ পান।

এতেও থেমে থাকেননি তিনি। স্বপ্ন তার আরও উপরে। যেভাবেই হোক বিসিএস ক্যাডার হতে হবে তার। অবশেষে বিসিএস ক্যাডার ধরা দেয় তার কাছে। ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নড়িয়া সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে তৃপ্ত হতে পারেননি তিনি। স্বপ্ন তখনো তাড়া করছিল পছন্দের প্রশাসন ক্যাডারের প্রতি। অবশেষে তার সেই অধরা স্বপ্নকে সফল করলেন তিনি। ৪৪তম বিসিএসে হলেন প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত। তার এমন সাফল্যে খুশি সবাই।

উল্লাস পাল বলেন, আমি রেজাল্ট দেওয়ার কথা শুনে প্রশাসন ক্যাডারে আমার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার মিলাচ্ছিলাম। যখনি আমার নম্বরটি মিলে যায় আনন্দে চোখ দিয়ে জল বের হয়ে যায়। আমার পরিবারের সবাই ভীষণ খুশি হয়েছে। আসলে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় সমাজের অনেকেই ঠাট্টা মশকরা করেছে। আবার অনেকেই ভীষণ ভালোবেসেছে। আমি কখনো দমে যাইনি, আমি লক্ষ্য স্থির রেখে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি।

তিনি বলেন, আমি প্রথমে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলাম। তবে আমার ইচ্ছে ছিল প্রশাসন ক্যাডার। যার জন্য আমি পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি। অবশেষে আমি সফল হয়েছি। আমার সেই কাঙ্ক্ষিত প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি।

তিনি আরও বলেন, এখন সরকার যেখানে আমাকে দায়িত্ব দেবে আমি যেন সেই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে পারি এটাই ইচ্ছা। এছাড়া আমি সবসময় মানুষের পাশে থেকে তাদের সেবা করে যেতে চাই। কেননা প্রশাসন ক্যাডার একটি জনকল্যাণমূলক ক্যাডার।

শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, যারা শারীরিক বা মানসিকভাবে ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন সমাজ চাইলেই তাদের জন্য সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারে। আমি চাই যারা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নিয়েছে সমাজের কেউ তাদের প্রতি যেন বিরূপ মনোভাব না দেখায়।

উল্লাস পালের এমন স্বপ্নপূরণের সাফল্যে খুশি তার পরিবার ও স্কুলের শিক্ষকরা। উল্লাস পালের মা আন্না রানী পাল বলেন, ছোটবেলা থেকেই উল্লাস অনেক সংগ্রাম করে বড় হয়েছে। তবে আমার ছেলেটা পড়াশোনায় ভীষণ মনোযোগী ছিল। যখন আজ দ্বিতীয়বারের মতো বিসিএস ক্যাডার হয়েছে ও তার পছন্দের প্রশাসন ক্যাডার পেয়েছে আমরা অনেক খুশি হয়েছি। আমরা ওকে নিয়ে গর্বিত। আমরা চাই ও সমাজের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাক।

উল্লাস পালের বাবা উত্তম কুমার পাল বলেন, ছোটবেলা থেকেই উল্লাসকে বিশেষভাবে যত্ন করে বড় করেছি। আমরা আমাদের চেষ্টায় কোনো প্রকার ত্রুটি রাখিনি। ওর লেখাপড়ার প্রতি অত্যধিক উৎসাহের জন্য আজ এই সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা সত্যিই আজ অনেক বেশি আনন্দিত।

উল্লাস পালের প্রতিবেশী রূপক পাল বলেন, মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করলেই সে সমাজের বোঝা নয়, সেটা আমাদের উল্লাস দেখিয়ে দিয়েছে। ও শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হওয়ার পর বলেছিল প্রশাসন ক্যাডার হবে। আজ উল্লাস ওর স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে। আমরা প্রতিবেশীরা ওর জন্য আশীর্বাদ করি।

কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক (বিএসসি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, উল্লাস আমাদের ছাত্র। ও শারীরিকভাবে একটু সমস্যা ছিল, তাই ঠিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারতো না। তবে ওর মেধা ছিলো প্রখর। ওর মতো সৎ, আত্মমর্যাদাশীল, দায়িত্বশীল ছেলে আমি সত্যিই কম দেখেছি। ওর রেজাল্টের খবর পেয়ে আমি অনেক খুশি হয়েছি। আমি চাই ওই ওর দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আরো এগিয়ে যাক।

#৪৪তম বিসিএস #প্রশাসন ক্যাডার