শিক্ষায় নিম্নমুখী বরাদ্দে ঊর্ধ্বমুখী অর্জন সম্ভব নয় | মতামত নিউজ

শিক্ষায় নিম্নমুখী বরাদ্দে ঊর্ধ্বমুখী অর্জন সম্ভব নয়

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ইন্টারনেট আবিষ্কার ও তথ্যপ্রযুক্তির সহজ ও দ্রুত ব্যবহারের ফলে তৃতীয় শিল্প বিপ্লব শুরু। তারই ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল বিপ্লবকেই বলা হয় চতুর্থ শিল্প।

বর্তমান বিশ্ব টিকে আছে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির ওপর। বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে শিল্প বিপ্লবের ফলে। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের নানামুখী ব্যবহারের ফলে ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম শিল্প বিপ্লব শুরু হয়। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ফলে এবং নানামুখী ব্যবহারে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব শুরু।

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ইন্টারনেট আবিষ্কার ও তথ্যপ্রযুক্তির সহজ ও দ্রুত ব্যবহারের ফলে তৃতীয় শিল্প বিপ্লব শুরু। তারই ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল বিপ্লবকেই বলা হয় চতুর্থ শিল্প। ম্যানুয়াল জগৎ ছেড়ে শুরু হয় ভার্চুয়াল জগতের।

এই বিপ্লবের মূল ভিত্তি জ্ঞান। নতুন নতুন উদ্ভাবনী ধারণা বদলে দিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির সব সনাতনী হিসাব নিকাশ। জ্ঞানভিত্তিক বর্তমান প্রজন্ম যে বিশাল আলোর প্রদীপ জ্বেলেছে তার নীচেও রয়েছে অস্বস্তিকর অন্ধকার।

বৈষম্যের দেয়ালে ঘেরা এই বিশ্বে এখনও ২০ কোটির বেশি শিশু রয়েছে সাধারণ শিক্ষার বাইরে। যারা যাচ্ছে তারাও আবার অনেক বিদ্যালয়ে গিয়ে যা শেখার তা শিখছে না। এ ভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দে নিম্ন আয়ের দেশে মধ্যে মাত্র দশভাগ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে আবার কম আয়ের দেশে এই সংখ্যা আরো কম হতে পারে। এই বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ পূর্বশর্ত।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। প্রাথমিক শিক্ষার মতো একেবারে গোড়া থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে নানারকম সংকট বিদ্যমান। এই সংকটগুলো শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের নয়, বরং সমগ্র জাতির উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। জাতীয় উন্নয়নের জন্য এই খাতের পুনর্গঠন অত্যন্ত জরুরি। সেই দিক বিবেচনায় বর্তমান অর্থবছরে শিক্ষায় যথাযথ অর্থায়ন প্রয়োজন।

২০২১-২২ অর্থবছরে ছিলো জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ২ দশমিক ০৮ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিলো জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ ছিলো জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ছিলো ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ক্রমান্বয়ে বরাদ্দ নিম্নমুখী ।

২ জুন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেয়া হতে পারে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। সে দিক থেকেও মোট বরাদ্দও নিম্নমুখী।

স্বভাবিক ভাবে অর্থমন্ত্রীরা বাজেট উপস্থাপন করে থাকেন জাতীয় সংসদে। সংসদ না থাকায় অর্থ উপদেষ্টা বাজেট উপস্থাপন করবেন টেলিভিশনের পর্দায়। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হয়। সর্বশেষ ২০০৭-০৮ খ্রিষ্টাব্দে টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে দুটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দেয়া হলেও নজর থাকবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জ্বালানি সাশ্রয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে এ বাজেটে সর্বোপরি মানুষের জীবনযাত্রা যেনো সহজ হয়। তাছাড়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা এবং শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের সুপারিশের প্রতিফলন থাকতে পারে বাজেটে। কারণ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকারের এটি হবে প্রথম বাজেট।

এশিয়ার সকল দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ সর্বনিম্ন। সেইসঙ্গে রয়েছে চরম বৈষম্য। ৯৫ ভাগ মানুষের সন্তানেরা মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জিডিপির অনুপাতে শিক্ষায় বরাদ্দ অন্তত ৬ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। শুধু তাই নয় শিক্ষা খাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটানে জিডিপির ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, আফগানিস্তানের ৪ দশমিক ১ এবং ভারত ও পাকিস্তান বরাদ্দ দেয় ২ দশমিক ৯ শতাংশ। শিক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এদের সবার চেয়ে নিচেই শুধু নয় নিম্নগামী। বাজেটের এ ভয়াবহ চিত্র একটি জাতির শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত বয়ে আনে।

শিক্ষাখাতকে ভবিষ্যতের উত্তম বিনিয়োগ বিবেচনায় প্রয়োজনীয় ব্যয় বরাদ্দ বাজেটে না থাকলে সমাজে বেকারত্ব ও অপরাধপ্রবণতা বাড়বে এবং তা ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে দেশের রাজনীতি, আইন, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি,সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে, যা জাতিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে কুফল ভোগ করতে হবে।

বাংলাদেশে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষকের অবস্থান, মর্যাদা ও বেতন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে চরম নিম্নগামী । শিক্ষকদের এ করুণ অবস্থা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। একটা সময় শিক্ষক বলতে বোঝাতো জীর্ণশীর্ণ চেহারা, মলিন জামা, পায়ে ছেঁড়া জুতা, হাতে তালি দেয়া ছাতা। ঠিক আজও শিক্ষকদের সেই একই দশা, রাজপথে তাদের বেতনের দাবিতে করুণ চিত্র দেখতে হয় প্রতিনিয়ত।

শিক্ষকদের জীবন মান উন্নয়নে এবং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেই বিশেষ অনীহা দেখা যায়। প্রশাসনিক মর্যাদার বিচারে শিক্ষকদের রাখা হয় পেছনের সারিতে । আমলাতান্ত্রিক অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার, মর্যাদা, দাবি আদায়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এ পেশায় আশা করা হয়, শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের অবস্থান।

কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের স্বপ্নকে বেঁধে রাখে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিচারক, প্রশাসক এ রকম কোনো না কোনো পেশায়। যেখানে প্রচুর টাকার পাশাপাশি রয়েছে সামাজিক শক্ত অবস্থান। তাছাড়া শিক্ষকদের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বিনিয়োগ স্বল্পতার কারণে দক্ষ শিক্ষকের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

শিক্ষা খাতে সঠিক ও পরিকল্পিত বিনিয়োগ ছাড়া দক্ষ শিক্ষকের অভাব নিরসন ও শিক্ষক পেশায় মেধাবীদের অবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের অবস্থান নিশ্চিত করা ছাড়া নতুন প্রজন্মকে সম্পদে পরিণত করা সম্ভবপর নয়। নতুন প্রজন্মকে সম্পদে পরিণত করতে না পারলে টেকসই উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতির প্রত্যাশা পূরণে নিম্নগামী বাজেট দিয়ে ঊর্ধগামী শিক্ষা সম্ভব নয়। তাই বাজেট প্রণয়ন সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনাবিদদের কাছে সুপারিশ থাকবে শিক্ষা খাতে যেনো অন্তত জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়।

লেখক: প্রধান শিক্ষক (অব.) ও কলাম লেখক