গভীর রজনীর কনকনে শীতের তীব্র দংশন উপেক্ষা করে সাত কলেজের, বিশেষ করে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা রাজধানীর রাস্তায় নেমে এলো আর তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শুরু হয়ে গেলো ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ। সাত কলেজের সমস্যা নতুন নয়। এর আগেও সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বহুবার বিভিন্ন ইস্যুতে রাস্তায় নেমেছেন। রাস্তায় নেমেছেন তিতুমীর কলেজ, নার্সিং ও ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থীরাও।
ঢাকার সায়েন্স ল্যাবের মোড়, নিউমার্কেট-নীলক্ষেত, শাহবাগ এবং মহাখালি যেনো আন্দোলনের হটস্পট হিসেবেই তৈরি হয়েছে। আবার কথায় কথায় ওই স্থানগুলো শুধু ছাত্ররাই দখলে নেন এমন নয়। রিকশাওয়ালা, মোটর-শ্রমিক, হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ, আন্দোলনরত আনসার ভিডিপিসহ অন্যান্য আন্দোলনকারীরাই বা পিছিয়ে থাকবে কেনো? দেখা গেছে তারাও চারপাশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেষ্টিত ওই স্থানগুলো দখল করে এলাকায় যান চলাচল বন্ধ করে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করে আসছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। শিক্ষা নিয়ে গবেষণা ও আলোচনার দ্বার যেখানে সবসময় উন্মুক্ত থাকবার কথা সেখানে এমন আন্দোলন করতে হবে কেনো? শহরে ঢোকা এবং বের হবার পথ বন্ধ করে দিয়ে রাস্তায় নামতে হবে কেনো? আবার ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষেই বা লিপ্ত হতে হবে কেনো?
তিতুমীর কলেজকে কেনো বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয় করবার মতো ভৌত অবকাঠামো কি তিতুমীর কলেজের আছে? আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হবার মতো যথেষ্ট বিভাগ, গবেষণাগার, যোগ্য শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবার মতো প্রশাসন-বিশেষজ্ঞ কি সেখানে আছেন? এমনিতেই আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা আছে, এই সমালোচনা দূর করবার জন্য কর্তৃপক্ষ কতোটুকু সচেষ্ট? দেশের বিভিন্ন স্থানে, অলিগলিতে ভুঁইফোড়ের মতো গজিয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজ। শোনা যায় কোনো কোনো মেডিক্যাল কলেজে বছরেও একটা লাশ-ডিসেকশনের ব্যবস্থা করা হয় না। এসব মেডিক্যাল থেকে পাশ করে আসা চিকিৎসকরা মানুষকে কীভাবে চিকিৎসা সেবা দেবেন? চিকিৎসক নিয়োগের নিমিত্তে আয়োজিত বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি টেস্টে ঢাকার বেশ নামীদামি একটি কেন্দ্রের পরীক্ষা প্রত্যক্ষ করবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। সেই সময় করোনার ভয় ছিলো বলে পরীক্ষা কক্ষ পরিদর্শকরা দূরে বসে ছিলেন আর সেই সুযোগে সেখানে নকলের মহোৎসব বসে গিয়েছিলো, গাইডবুক দেখে দেখে পরীক্ষার্থীরা গোল্লা ভরাট করে তাদের বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলো। উল্লেখ্য, এই ৪২তম বিসিএসের কোনো লিখিত পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। যারা এমসিকিউ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো তারা প্রায় সবাই চুড়ান্তভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলো। বিগত সরকারের আমলে একটি বিসিএস পরীক্ষায় ঢাকার বিশেষ একটি কলেজ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স পাস করা ১৮ জন প্রার্থী দলীয় তালিকা থেকে বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে এখন বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকের পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। এদের কমপক্ষে দুজনার সঙ্গে (ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক) আলাপ করার সুযোগ হয়েছিলো। সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে এই আলাপচারিতায় তাদের জানাশোনার বহর দেখে ক্ষোভে-দুঃখে মনটা বিষিয়ে উঠেছিলো। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সারা দেশের চালচিত্র মোটামুটি একই। কেনো দীর্ঘদিন ধরে চলছে এই অবস্থা? উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের পথ কি খুবই দুর্গম, খুবই বন্ধুর? না কি সমস্যা সমাধানের সদিচ্ছার চুড়ান্ত আকাল চলছে? আবার যদি বলা হয় ফায়দা হাসিলের কৌশল হিসেবে কোনো বিশেষ কুচক্রীমহল সমস্যাগুলোকে জিইয়ে রেখেছে, তবে কি খুব বেশি ভুল বলা হবে?
ছাত্র-অভিভাবকরে আর্থিক দুরবস্থা, দুর্ভোগ এবং যাতায়াতের সীমাহীন কষ্ট লাঘবে বিশ্বিবিদ্যালয়গুলোর গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়াকে দেশের আপামর জনসাধারণ সাধুবাদ জানিয়েছিলো কিন্তু শিক্ষামন্ত্রণালয়ের আহ্বানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে পাশ কেটে বেরিয়ে গেলো। এতে মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা ছাড়া কার কী মঙ্গল হলো সাধারণ জনগণের তা একেবারেই বোধগম্য নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ একটি শ্লোগান ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়েছিলো-‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’। দেশটা কি কারো একার, ১৭/১৮ কোটি মানুষের নয়? সুখের বিষয়, শ্লোগানটি এখন আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। কিন্তু কোটি কোটি মানুষের মঙ্গল চিন্তা করে মেডিক্যালে ভর্তির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতেও গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া চালু রাখাটা অধিক জনহিতকর বলেই অনেকের ধারণা। এ বিষয়টি আরো একবার গুরুত্ব এবং আন্তরিকতার সঙ্গে ভেবে দেখবার দাবি রাখে। দেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ এবং সুশীল সমাজ এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসবেন বলে আশা করা যায়।
শিক্ষা সমাজ পরিবর্তন এবং সমাজের সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম হাতিয়ার--এ কথা শুনতে শুনতে অনেকেরই কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের মদদপুষ্ট তথাকথিত শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের ‘গিনিপিগ টেস্ট’ আমাদের শিক্ষাকে কোন স্তরে নামিয়ে দিয়েছে এটা বুঝতেও এখন আর খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত মোট ৭টি শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে, যার বিস্তারিত আলোচনা এখানে অবান্তর। সর্বশেষ শিক্ষাকমিশনের অনেকগুলো সুপারিশের মধ্যে কয়েকটি ছিলো= ১. সমাজ ও রাষ্ট্রীয় চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাস্তর নির্ধারণ করা ২. ধর্মীয় মূল্যবোধকে নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা ৩. মাদরাসা শিক্ষাকে উন্নত ও বিজ্ঞানসম্মত করা ৪. উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় কম্পিউটর ও ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্যপ্রযুক্তি সংযুক্ত করা ৫. নকল রোধ করার জন্য পরীক্ষা পদ্ধতিকে পুনর্বিন্যাস করা ৬. নোটবই ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা ৭. শিক্ষকদের দায়িত্ব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা ৮. শিক্ষা প্রশাসনকে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব মুক্ত করা। ৯. শিক্ষার সুযোগ ও উপকরণ বৃদ্ধি করা ১০. সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হতে হবে সৎ, নীতিবান, যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক গড়ে তোলা।
সাম্প্রতিককালে শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা যে উন্নতি হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশে কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে আশাব্যঞ্জকভাবে, নারীশিক্ষার প্রসার ঘটেছে, প্রশাসন ও শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু অদ্যাবধি নোটবই, কোচিং বাণিজ্য কোনোকিছুই বন্ধ হয়নি, শিক্ষা প্রশাসন রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত হয়নি, পাঠ্যক্রম প্রণয়নে দূরদর্শিতার পরিচয় মেলেনি, শিক্ষকদের দায়িত্ব ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়নি, এমনকি সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিও বন্ধ করা যায়নি। গত কিছুদিনের বিভিন্ন ইস্যুতে ছাত্রদের রাস্তায় নেমে আন্দোলনের ঘটনা প্রমাণ করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও পরিশীলন এখনো হয়নি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি অর্থাৎ দেশীয় আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো সৃজনশীল, উৎপাদনশীল, দায়িত্ববান ও কর্তব্যনিষ্ঠ জনবল তৈরি করে আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা থেকে অনেক দূরে।
গবেষণালব্ধ প্রকাশনাই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ধারক হলেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা কার্যক্রম হতাশাব্যঞ্জক। শুধু একাডেমিক স্বার্থে অর্থাৎ পিএইচডি অর্জিত না হলে প্রফেসর হওয়া যাবে না বা প্রোমোশন হবে না এমন শর্ত পূরণেই শিক্ষকরা গবেষণার কাজে অংশ নেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার মান ও পরিমাণ কোনোটাই বাড়েনি বরং এখানে ঘটেছে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার পরাজয় এবং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। শিক্ষার্থীদের কথা না হয় বাদই দেয়া হলো। কিন্তু সম্মানিত শিক্ষকদের নৈতিক উন্নতি কি দৃশ্যমান? সে প্রশ্নের জবাব অবশ্যই নেতিবাচক। দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ছয় মাস অতিক্রম হতে চলেছে কিন্তু শুরুটা যেমনটি হয়েছিলো বর্তমানে সেটি দৃশ্যত স্থবির হয়ে পড়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। সংস্কারের চেয়ে আশু নির্বাচন দেয়াটাই যেনো বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি পেতে মেধাবীরা এখনো আগের মতোই বঞ্চিত। যেনো সেই পুরনো মদই নুতন গ্লাসে বিক্রি হচ্ছে।
সর্বশেষ শিক্ষাকমিশনের সুপারিশ তো রয়েছেই, বাস্তবায়নের অসুবিধাটা কোথায়? এখনো যদি সেই পুরনো আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক জটিলতা থাকবে তবে বিপ্লবের সুফল কোথায়? একুশ শতকের গতিময় আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে, জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতিতে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে বর্তমান স্থিতাবস্থা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের জাতীয় উন্নয়নে মেধা চর্চা ও তার লালন একান্ত প্রয়োজন। কারণ, মেধাবী জাতিই সমস্ত আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে। আর সে জন্যই যা একান্ত জরুরি তা হলো শিক্ষাব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু পরিবেশ দ্রুত ফিরিয়ে আনা।
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়