করিডর, ত্রাণ চ্যানেল, সেনাবাহিনী, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ, নিজের নাগরিকত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। যা নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। দৈনিক শিক্ষার পাঠকদের জন্য বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, রাখাইনের জন্য করিডর নিয়ে সরকার কারও সাথে কোন কথা বলেনি এবং বলবেও না।
তবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ত্রাণ সরবরাহের একটি 'চ্যানেল বা পাথওয়ে' তৈরির জাতিসংঘের প্রস্তাব বাংলাদেশ বিবেচনা করছে।
তিনি বলেছেন, যেহেতু সংঘাতের কারণে সাহায্য সরবরাহের অন্যান্য সকল পথ বর্তমানে অকার্যকর, তাই বাংলাদেশই এখন একমাত্র সম্ভাব্য বিকল্প।
"জাতিসংঘের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশে একটি করিডর দেয়ার যে গুজব তৈরি হয়েছে, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি যে, করিডর নিয়ে আমাদের সাথে কারও কোন কথা হয়নি। এবং কারও সাথে কথা হবেও না," ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন তিনি এবং একই সাথে এই করিডর বিষয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে মতবিরোধের খবরও নাকচ করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, "জাতিসংঘ কার্যক্রম, যেটা রাখাইনে চলছে সেটা চলা আর সম্ভব না। যুদ্ধাবস্থার কারণে মানবিক ত্রাণ রাখাইনে নেওয়া যাচ্ছে না। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন আমরা ত্রাণ পাঠাতে সাহায্য দিতে পারি কি না। আমরা সেটা বিবেচনা করছি"।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত ২৭ এপ্রিল ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের জন্য শর্ত সাপেক্ষে মানবিক করিডর দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে।
তখন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, "এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ বা পাথওয়ে একটা হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব"।
এরপরই মানবিক করিডর বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে এবং এর বিরোধিতা করে। অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার এখতিয়ার আছে কি-না, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করে।
এমনকি বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সরকারের মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে আমেরিকা করিডরের জন্য চাপ দিচ্ছে- এমন বিভিন্ন খবরও নানা মাধ্যমে প্রচার হতে শুরু করে।
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এসব বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি দাবি করেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন এবং তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
তাছাড়া জাতিসংঘ, মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির সাথে আলোচনার কথা জানালেও করিডর বা এসব বিষয়ে সরকারের ওপর কোনো চাপ নেই বলে দাবি করেছেন তিনি।
"আমেরিকা কেন, আমরা কারো চাপের মুখে নেই। কেউ চাপ দিচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সবার সাথে কথা বলছি। তাহলে যেটা নেই (চাপ), সেটা তো আমি অনুভব করতে পারছি না," সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন মি. রহমান।
মানবিক করিডর ইস্যু
সংবাদ সম্মেলনে খলিলুর রহমান বলেন, তারা রাখাইনের জন্য করিডর নিয়ে কারও সাথে কোন কথাই বলেননি। তার মতে করিডর হচ্ছে জরুরি সময়ে দুর্যোগপূর্ণ জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু এখানে কাউকে সরানো হচ্ছে না।
"করিডর নিয়ে কথা বলিনি, বলবো না। আরাকানের যে অবস্থা তাতে করিডরের প্রয়োজনীয়তা নেই। যে প্রয়োজন আছে তা হলো ত্রাণ পৌঁছে দেয়া। আমাদের ধারণা কাজটি করতে পারলে সেখানকার পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে। তাহলে আমরা প্রত্যাবাসনের কথা বলতে পারবো," বলছিলেন মি. রহমান।
তিনি বলেন, যেহেতু জাতিসংঘের যে কার্যক্রম রাখাইনে চলছে সেটা চলা আর সম্ভব না এবং যুদ্ধাবস্থার কারণে মানবিক সহায়তা রাখাইনে নেয়া যাচ্ছে না। সে কারণে জাতিসংঘ মহাসচিব জানতে চেয়েছেন এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাহায্য করতে পারে কি-না।
"আমরা সেটা বিবেচনা করছি। জাতিসংঘের তরফ থেকে আরাকান আর্মিকে জানানো হয়েছে এই সহযোগিতা বিতরণে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা যাবে না, কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা যাবে না"।
রাখাইনের নব্বই শতাংশ জায়গাই আরাকান আর্মির দখলে। ফলে বাংলাদেশ একই সমান্তরালে মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির সাথে কথা বলছে বলে জানান তিনি। দু পক্ষই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তাদের নীতিগত অবস্থানের কথা জানিয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী করছে
খলিলুর রহমান বলেন, ইউএনডিপির মতে রাখাইনে ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় খাবার ও ঔষধ না পেয়ে লোকজন আসতে পারে এবং বাংলাদেশ আশঙ্কা করছে যে, এমন পরিস্থিতি রাখাইন থেকে আরও মানুষকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করা হতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ মনে করে এ সমস্যার একমাত্র সমাধান রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন।
"এ কাজের সব অপশন টেবিলে থাকবে। আমাদের সব কূটনৈতিক ও অন্য সামর্থ্য দিয়ে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবো"।
বাংলাদেশে গত আট বছর ধরে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এই ভার বহনের সীমা পার হয়ে গেছে উল্লেখ করে খলিলুর রহমান বলেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক সংকট বাড়ছে এবং এই পরিপ্রেক্ষিতেই জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশ মানবিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করতে শুরু করে।
"যেহেতু সংঘাতের কারণে সাহায্য সরবরাহের অন্যান্য সকল পথ বর্তমানে অকার্যকর, তাই বাংলাদেশই এখন একমাত্র সম্ভাব্য বিকল্প। প্রাথমিকভাবে চিন্তা করা হয়েছিল যে জাতিসংঘ তার চ্যানেলের মাধ্যমে রাখাইনে সহায়তা বিতরণের ব্যবস্থা করবে এবং মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে সহায়তা পৌঁছাতে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করবে। এ ছাড়া, বাংলাদেশ মনে করে যে রাখাইনে সাহায্য প্রদান রাজ্যটিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে এবং সেটি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পথ প্রশস্ত করবে," তিনি বলেন।
তবে তিনি জানান যে, রাখাইনে সাহায্য প্রদানের ব্যাপারে এখনো কোনো চুক্তি হয়নি, কারণ এর জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সম্মতি এবং সহায়তা প্রদানের জন্য বিশ্বের অন্য সব জায়গার মতো এখানেও বেশকিছু পূর্বশর্ত পূরণের প্রয়োজন আছে। এর মধ্যে রয়েছে, সহায়তা প্রদানকারী এবং গ্রহীতাদের নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার, সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য না করা, সহায়তাকে সামরিক উদ্দেশে ব্যবহার না করা এবং সশস্ত্র কার্যকলাপ স্থগিত রাখা।
এক প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ( ত্রাণ পাঠানোর সম্ভাব্য চ্যানেল বা পাথওয়ের) পুরো কন্ট্রোল থাকবে জাতিসংঘের, ওপারে নিয়ে যাওয়ার পরে সেখানকার নিরাপত্তা, সবকিছু তাদের দায়িত্ব।
"আমাদের দায়িত্ব সীমান্ত পর্যন্ত, সেখানে মাদক পাচার হচ্ছে কিনা, অন্য কিছু হচ্ছে কিনা, সেটা আমরা দেখবো। দুই পক্ষ সম্মত হলে এবং সংঘাত কমলেই শুধু আমরা যাবো"।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে মতবিরোধ প্রসঙ্গ
সামাজিক মাধ্যমে গত কিছুদিন ধরেই অনেকে দাবি করছেন যে সরকার 'মানবিক করিডর' দিতে যে উদ্যোগ নিচ্ছে তাতে সেনাবাহিনী একমত নয় কিংবা বিরোধিতা করছে।
যদিও সেনাবাহিনীর দিক থেকে কখনোই এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করা হয়নি কিংবা আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের কোন মতামত তারা প্রকাশও করেনি।
সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে তার সমন্বয়হীনতার দেখা যাচ্ছে কি-না এ ধরনের একটি প্রশ্ন উঠে আসে।
জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, "সেনাবাহিনীর সাথে কোন মতপার্থক্য নেই। সেনাপ্রধানের সাথে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে আমরা এক সমতলে অবস্থান করছি। এ নিয়ে কোন ফাঁকফোকর নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয়হীনতার সুযোগ নেই আর সেনাবাহিনীর সাথে আমি খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি।
"পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যা বলেছেন স্লিপ অফ টাং। সাথে সাথেই সংশোধন করে উনি পাথওয়ে বলেছেন। সেটা ঠিক বলেছেন এবং করিডরের কথা আর কখনোই তিনি বলেননি," বলেছেন মি. রহমান।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপ, প্রক্সি ওয়ার প্রসঙ্গ
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকেই বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের খবর বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আসছিলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এমন মন্তব্য করেছিলেন। যদিও তখন তা যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করেছিলো।
এবার মানবিক করিডরের বিষয়টি আলোচনায় আসার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের চাপের ইস্যুটি সামনে উঠে আসে। অনেকে মনে করেন, মিয়ানমারে চীনের প্রভাব কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র নানা কৌশলে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চাইছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে মি. রহমান বলেন, "আমেরিকা কেন, আমরা কারো চাপের মুখে নেই। কেউ চাপ দিচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সবার সাথে কথা বলছি। তাহলে যেটা নেই, সেটা তো আমি অনুভব করতে পারছি না"।
তিনি বলেন, করিডরের প্রচারণা বাংলাদেশ থেকে আসেনি, এটা এসেছে প্রতিবেশী দেশের নিউজ পোর্টাল থেকে। তারাই বলছে জাতিসংঘকে নিয়ে আমেরিকার হয়ে প্রক্সি যুদ্ধে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
"কিন্তু আমেরিকার পক্ষে প্রক্সি যুদ্ধ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কে? ওখানে চীনের কারণে বার্মার এক অংশ কেটে ফেলতে চাইছে এসব কথাবার্তা। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। অপপ্রচার করবেন না। এটা বন্ধ করেন। দেশের স্বার্থ বলতে একটা কিছু আছে"।
সীমান্তের কোন জায়গা ব্যবহার হবে?
জাতিসংঘ যদি বাংলাদেশকে ব্যবহার করে রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পাঠায় তাহলে তার জন্য সীমান্তের কোন জায়গা ব্যবহার করা হবে, এমন প্রশ্নও এসেছে সংবাদ সম্মেলনে।
জবাবে মি. রহমান বলেন, "সব পক্ষ যদি রাজি হয়, যেটা আমাদের জন্য ভালো হবে। তবে সেই পর্যায়ে যায়নি এখনো বিষয়টা। নিজস্ব বিবেচনা আছে আমাদের। রুট, নিরাপত্তা এগুলো দেখতে হবে। বহু কিছু বিবেচনার বিষয় আছে। সব অংশীজনের সাথে বসে ঠিক করবো। কোন কিছুই এখনো বিবেচনার জায়গায় আসেনি। সবাইকে নিয়েই সেই বিবেচনা করবো"।
তিনি বলেন, আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সরকারের সাথে জাতিসংঘকে সামনে রেখেই আলোচনা হচ্ছে।
"আলোচনাগুলো জাতিসংঘকে মাঝে রেখে করি। আমরা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা পর্যবেক্ষণে রাখবো। যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাসভঙ্গের কারণ না হয় ততক্ষণ বিশ্বাস রাখবো। ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সাথে বৈঠক হয়েছে। বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ হয় কাজে, এজন্য সময় লাগে। এ বিষয়টা খুব সতর্কতার সাথে হ্যান্ডেল করতে হবে," বলছিলেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন কোন এগ্রিমেন্ট না হলে জাতিসংঘের কোন কাজ লিখিত হয় না। সব পক্ষের সম্মতি না থাকলে এবং সব কিছু চূড়ান্ত না হলে কিছু লিখিত হয় না।
তিনি বলেন, আরাকান আর্মিকে আগে তাদের ঘর ঠিক করতে হবে।
"সে যদি জাতিগত নিধন চালায় কিংবা বর্ণবাদী রাষ্ট্র কায়েম করতে চায় তাহলে আমরা কেন সহায়তা করবো। প্রশ্নই উঠেনা"।
মি. রহমান জানান যে, বাংলাদেশ সরকার রাখাইনে মানবিক সহায়তা প্রদান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং আরাকানের শাসন ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা কাঠামোর সকল স্তরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও অন্তর্ভুক্তির বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার স্বার্থে আরাকান বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রেখেছে।
"বাস্তবিক প্রয়োজনেই আরাকান বাহিনীর সাথে বাংলাদেশের এই যোগাযোগ। একইসঙ্গে, মিয়ানমার সরকারের সাথেও যোগাযোগ বজায় রাখছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সংকট টেকসইভাবে সমাধানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সাথে যোগাযোগ রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।''
''আরাকান সশস্ত্র বাহিনী যখন মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অংশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখন বাংলাদেশ সরকার তাদের সাথে যোগাযোগ রাখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। নিজ সীমান্ত রক্ষা এবং শান্তিপূর্ণ রাখা বাংলাদেশের কর্তব্য। এ কারণেই, বাংলাদেশ আরাকান সেনাবাহিনীর সাথে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের সিদ্ধান্ত নেয়" বলেন খলিলুর রহমান।
বাংলাদেশ কী কী শর্ত দিয়েছে
বাংলাদেশি কর্মকর্তারা সম্প্রতি বলেছেন যে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তার প্রস্তাবে বাংলাদেশের সম্মতির জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে।
সেই শর্তগুলো কী কী এবং এই বিষয়ে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
মি. রহমান বলেন প্রথমত সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সহায়তা প্রদানের বিষয়ে একমত হতে হবে। পাশাপাশি আরাকান বাহিনীকে নিশ্চিত করতে হবে যে সহায়তা প্রদানকারী এবং গ্রহীতাদের প্রবেশাধিকার যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সহায়তাকে সামরিক উদ্দেশে যেন ব্যবহার না করা হয় এবং কোনো সশস্ত্র কার্যকলাপ যেন না ঘটে।
"আরাকান বাহিনী রাখাইনের শাসনব্যবস্থা ও নিরাপত্তা কাঠামোর সকল স্তরে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করে রাখাইনে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এই প্রতিশ্রুতির প্রতি তাদের অবিচল থাকতে হবে।
তা না হলে এটিকে সারাবিশ্বে জাতিগত নিধন হিসেবে দেখা হবে, যা বাংলাদেশ মেনে নেবে না। আমরা এ বিষয়ে আরাকান বাহিনীর প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছি"।
মানবিক সহায়তা প্রদানে নিরাপত্তা ঝুঁকি কী কী?
এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে মানবিক সহায়তা যিনি প্রদান করেন এবং যিনি গ্রহণ করেন উভয়ের জন্যই নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে।
"ল্যান্ডমাইন ও আইইডির মতো বিস্ফোরক নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য হুমকি। সহায়তা প্রদানের আগে এই বিষয়গুলো সমাধান করা প্রয়োজন। আসন্ন মানবিক বিপর্যয় থেকে মানুষের জীবন বাঁচানো বিশ্ব সম্প্রদায়ের একটি সম্মিলিত দায়িত্ব।
এই সংকট মোকাবিলায় সবাইকে একযোগে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। রাখাইনে স্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অন্যতম অগ্রাধিকার। স্থিতিশীল না হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতির সম্ভাবনা একেবারেই কম।''
তিনি বলেন, ''আগের সরকারের সময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোন উদ্যোগই ছিলো না। এখন আরও মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ না করে সেটি ঠেকাতে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয় করছে।''
"বাংলাদেশ সরকার আরাকান বাহিনীকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর আর কোনো সহিংসতা, বৈষম্য এবং বাস্তুচ্যুতি যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। আরাকান বাহিনীকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনসহ সকল আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে।
গোটা বিশ্ব তাদের কার্যক্রম দেখছে। বাংলাদেশ আরাকান বাহিনীর সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে কি না তা এই অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম এবং রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বের ওপর নির্ভর করবে," বলেছেন তিনি।
মি. রহমান বলেন, জাতিসংঘের তরফ থেকেও আরাকান আর্মিকে জানানো হয়েছে, এই সাহায্য বা সহায়তা প্রাপ্তি বা বিতরণের ব্যাপারে কোনরকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। যুদ্ধের কাছে ব্যবহার করা যাবে না।
"আর আর আমাদের তরফ থেকে শঙ্কা হচ্ছে, আরাকানের যে নতুন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও নিরাপত্তামূলক প্রশাসন তৈরি হয়েছে, সেখানে আমরা রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের চিহ্ন দেখছি না। আমরা আরাকান আর্মিকে সরাসরি বলেছি, আমরা কোনরকম জাতিগত নিধন সহ্য করবো না। তাদের বলেছি, তারা যদি শুধু রাখাইনদের নিয়ে রাজ্য পরিচালনা করতে চায়, তাহলে তারা হবে একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র," বলেছেন তিনি।
পাসপোর্ট ও নাগরিকত্ব বিতর্ক
গত কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের আলোচনায় মি. রহমানের অন্য দেশের নাগরিকত্ব আছে এমন অভিযোগ করে আসছিলেন।
আজ এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেছেন তার একটি জাতীয়তা- বাংলাদেশি।
"আমার আমেরিকান পাসপোর্ট নেই। বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশের জাতীয়তা নেই। আমেরিকায় থাকার কারণে আমাকে বিদেশি বললে কাল তো তারেক রহমানকেও বলবে। পারলে প্রমাণ করেন। আমার তো অধিকার আছে। সেটাকে সম্মান তো করতে হবে," বলেছেন তিনি।