প্রতি বছর বাজেট আসলেই শোনা যায়, হাজার হাজার থেকে লাখ লাখ কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট। প্রশ্ন হলো প্রতিবছরই কেন ঘাটতি বাজেট হয়? উদ্বৃত্ত বাজেট তৈরি হয় না কেন? অনেকেই আবার ঘাটতি আর উদ্বৃত্তের হিসেবেও কখনো কখনো গোল পাকিয়ে দেন।
যেমন একটি শীর্ষ দৈনিক বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের বাজেটকেই উদ্বৃত্ত বাজেট দেখিয়ে প্রকাশ করেছে। যদিও পরে পত্রিকাটি নিজেদের ভুল স্বীকার করেছে। আমাদের ছোট্ট দেশের ৫৫ থেকে ৬২ লাখ কোটি টাকার জিডিপির পরও কেন ঘাটতি বাজেটই করতে হয়?
এর একটি উত্তর হলো, আমাদের মত দেশের উদ্বৃত্ত বাজেট করার সামর্থ নেই। তবে তাই বলে বিশ্বের কোন দেশ যে উদ্বৃত্ত বাজেট তৈরি করে না, তা কিন্ত নয়।
উদ্বৃত্ত বাজেট মানে হলো একটি দেশের আয় তার ব্যয়ের চেয়ে বেশি। চিন্তা করেন তো আমাদের মত দেশের কি সেই অবস্থা আছে? যখন প্রতিবছর বাজেটের আগে আমাদের অর্থ মন্ত্রীদের বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের কাছে ছুটোছুটি করতে হয়।
কোনো আর্থিক বছরে সরকারের প্রত্যাশিত আয় অপেক্ষা ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হলে তাই ঘাটতি বাজেট। সরকার বাজেটের এ ঘাটতি দূর করার লক্ষ্যে জনসাধারণের কাছ থেকে ঋণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান গ্রহণ করে থাকে।
ব্যক্তি যখন চিন্তা করে তার আয় কত টাকা, সেই অনুযায়ী ব্যয়ের খাত ঠিক করে। রাষ্ট্র করে ভিন্ন চিন্তা। রাষ্ট্র আগে ঠিক করে তার আগামী এক বছরে কোথায় কত টাকা লাগবে। সেই অনুযায়ী সে আয় করা চেষ্টা করে। মোটা কথায় এটাই হলো উন্নতির আকাঙ্খা। ব্যক্তি মত রাষ্ট্র যদি আয় বুঝি ব্যয় করতে থাকে তাহলে আর নতুন নতুন আয়ের খাত খুজে বের করবে না।
নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ,ব্রুনাই ও ডেনমার্কের মত দেশগুলো উদ্বৃত্ত বাজেট করে থাকে।
যে দেশগুলোতে সাধারণত উদ্বৃত্ত বাজেট তৈরি হয়, তাদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। আমাদের এখন পর্যন্ত জিডিপি মাত্র ৫৫ লাখ কোটি থেকে ৬২ লাখ কোটিতে উঠানামা করছে। তাই জিডিপির ১২-১৩ শতাংশ দিয়ে এবার অর্থ উপদেষ্টা বাজেট তৈরি করেছেন। সাধারণত জিডিপির ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাজেট করা যায়।
অর্থ উপদেষ্টা এবার যদি সাড়ে পাচঁ লাখের মধ্যে বাজেট করতে পারতেন তাহলে তার খুব ঘাটতি থাকতো না। কিন্ত তা তো সম্ভব নয়। কারণ পরিচালন ব্যয় আর অতীতের লোনের কিস্তি দিতেই তার এই পরিমান টাকা লাগবে। ফলে আয়ের আকাঙ্খা জিয়ে রাখতেই ঘাটতি বাজেট তৈরি করতে হয় অর্থ মন্ত্রীদের। যেমনটা চলতি সরকারে অর্থ উপদেষ্টাও করেছেন।
কেন, কিভাবে কিছু দেশ উদ্বৃত্ত বাজেট করে?
কিছু দেশ যারা প্রায়শই উদ্বৃত্ত বাজেট তৈরি করে বা অতীতে করেছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
নরওয়ে: তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত বিপুল রাজস্বের একটি বড় অংশ তারা তাদের সরকারি পেনশন তহবিল এ বিনিয়োগ করে। এই বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনার কারণে তারা নিয়মিতভাবে উদ্বৃত্ত বাজেট বজায় রাখে।
সিঙ্গাপুর: দক্ষ কর ব্যবস্থা, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং কৌশলগত বিনিয়োগের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর সব সময় উদ্বৃত্ত বাজেট তৈরি করে।
জার্মানি: জার্মানি তার শক্তিশালী অর্থনীতি এবং সুষম আর্থিক নীতির কারণে প্রায়শই উদ্বৃত্ত বাজেট দেখে।
সুইজারল্যান্ড: স্থিতিশীল অর্থনীতি এবং শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য এটি পরিচিত।
কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রুনাই: এই দেশগুলো প্রধানত তেল ও গ্যাসের বিশাল রিজার্ভ এবং রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত আয়ের কারণে বড় ধরনের বাজেট উদ্বৃত্ত তৈরি করে।
ডেনমার্ক: ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ডেনমার্ক অন্যতম দেশ যারা নিয়মিতভাবে বাজেট উদ্বৃত্ত দেখায়।
এই দেশগুলো কেন উদ্বৃত্ত বাজেট তৈরি করে?
প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার: তেল, গ্যাস বা অন্যান্য মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত বিপুল আয়।
দক্ষ আর্থিক ব্যবস্থাপনা: সরকার কর্তৃক ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, কর আদায়ে দক্ষতা এবং সুষম আর্থিক নীতি গ্রহণ।
শক্তিশালী অর্থনীতি: একটি গতিশীল এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি যা উচ্চ কর রাজস্ব নিশ্চিত করে।
সঞ্চয় ও বিনিয়োগ নীতি: ভবিষ্যতের জন্য অর্থ সঞ্চয় এবং উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
তবে, এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে বাজেট পরিস্থিতি প্রতি বছর পরিবর্তিত হতে পারে এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, বিশ্ব অর্থনীতি এবং সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে।