প্রতি বছরই সারা বিশ্বে পালিত হয় বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস প্রতি বছর ১১ জুলাই পালিত একটি সাংবাৎসরিক আয়োজন, যার লক্ষ্য বিশ্ব জনসংখ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের ওপরে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জুলাই বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটি ছাড়িয়ে গেলে সারা বিশ্বের জনমানুষের মধ্যে যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়, তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির পরিচালনা পরিষদ এই দিবসটি প্রতিষ্ঠা করে।
বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের লক্ষ্য হলো পরিবার পরিকল্পনা, লৈঙ্গিক সমতা, দারিদ্র্য, মাতৃস্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মতো জনসংখ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি বিশ্বের মোট জনসংখ্যা পৌঁছাবে ৮০১ কোটি ৯৮ লাখ ৭৬ হাজার ১৮৯ জনে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা বেড়েছে ৭ কোটি ৫১ লাখ ৬২ হাজার ৫৪১ জন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পরিসংখ্যান দপ্তর ইউএস সেনসাস ব্যুরো এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছিলো।
জাতিসংঘ এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে বিশ্ববাসীকে শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ প্রজন্ম, সক্ষম দম্পতি, তাদের ছোট পরিবার গঠন, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, মা ও শিশুমৃত্যু রোধে স্বাস্থ্যসেবা, বাল্যবিয়ে না হওয়া, সহিংসতা, বৈষম্য ও মানবাধিকার নিয়ে প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে নানা সচেতনতামূলক বিভিন্ন কাজ করে আসছে। কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তারা নানা ধরনের কাজ করে থাকে।
এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বে প্রতি ১০ থেকে ১৫ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ১০০ কোটি । এমন বৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়েছে ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। তখন বিশ্বে জনসংখ্যা ছিলো ৫০০ কোটি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ প্রবণতায় ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বিশ্ব জনসংখ্যার যে চিত্রটি দাঁড়াবে, তা হিসাব করে জনমিতিবিদরা উদ্বেগের সঙ্গে বলেছেন-হয়তো একটা পৃথিবীতে এত মানুষের তখন সংকুলান হবে না। প্রয়োজন হবে আরো তিনটি পৃথিবীর। তাহলে ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল বাংলাদেশের অবস্থা কী দাঁড়াবে! বলা হচ্ছে, শতসহস্র বছর লেগেছিলো বিশ্বে ১০০ কোটি মানুষ হতে। পরবর্তী ২০০ বছরে বা তারও বেশি সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৭ গুণ।
এরপর ১৯৮৭-তে বিশ্ব জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৫০০ কোটি, ১৯৯৭-তে ৬০০ কোটি, ২০১১-তে ৭০০ কোটি, ২০২১-এ ৭৯০ কোটি, ২০৩০-এ হবে ৮৫০ কোটি। ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৯৭০ কোটিতে, আর ২১০০ খ্রিষ্টাব্দে হবে ১ হাজার ৯০ কোটি। বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৯টি দেশে : ভারত, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, আমেরিকা, উগান্ডা, ইন্দোনেশিয়া। উল্লেখ্য, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দেই ভারত হয়ে গেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জন-অধ্যুষিত দেশ, যা চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বর্ধনশীল দেশ হলো নাইজেরিয়া। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যেখানে প্রতি মিনিটে ২৫০ শিশুর জন্ম হয়।
বিশ্বে ২০১০ থেকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মানুষের গড় আয়ু ছিলো ৬৭ থেকে ৭১ বছর। ২০৪৫ থেকে ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দে এ গড় আয়ু দাঁড়াবে ৭৭ বছরে। ২০৯৫-২১০০ খ্রিষ্টাব্দে সম্ভাব্য গড় আয়ু হবে ৮৩ বছর। এ পরিপ্রেক্ষিতে ষাটের দশক থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনমিতিক সূচকের ব্যাপক অগ্রগতি প্রশংসনীয় : জনসংখ্যা বৃদ্ধি ১.৩৭ শতাংশ, পরিবারপ্রতি গড় সন্তান ২.০৪, মাতৃমৃত্যু ১.৬৩ (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে), নবজাতকের মৃত্যু ০-২৮ দিন ১৫ জন (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে), ০-১ বছরের শিশুমৃত্যু ১১ জন (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে), ০-৫ বছরের শিশুমৃত্যু ২৮ জন (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে), পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ৬৩.৯ শতাংশ, অপূর্ণ চাহিদা হ্রাস ১২ শতাংশ। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২.৮ বছর।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ৬৬ শতাংশ (১০ কোটি ৫৬ লাখ, ইউএনডিপি) । পাশাপাশি পুষ্টি কার্যক্রম, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, অটিজম সেবা ও পরামর্শের মাধ্যমে প্রতিটি পরিবারে শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় এবং মা-শিশু স্বাস্থ্যে অর্জিত সূচক-সাফল্য রক্ষা করতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ৫৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের তৃণমূল পর্যায়ের লব্ধ জ্ঞান-অভিজ্ঞতায় ঘর থেকে ঘরে, ওয়ার্ড থেকে কমিউনিটিতে, সমতল থেকে দুর্গম জনপদে মানবিক ‘মেন্টর’ হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। অধিক জনসংখ্যার কারণে মানুষ-প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। এ কারণে গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলোর-কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, জলীয়বাষ্প, ওজোন, সিএফসির অতিরিক্ত ব্যবহারে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশ এ জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত দুর্যোগের অনিবার্য শিকার হয়ে তীব্র দাবদাহ, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, বজ্রপাত, ভূমিকম্প, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এদেশের মানুষ, কৃষিজমি, সামগ্রিক উন্নয়ন ও অর্থনীতির ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় একদিকে যেমন বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরঘেঁষা অঞ্চল, মালদ্বীপ, নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিউল, টোকিওসহ বহু উপকূলীয় অঞ্চল সমুদ্রে তলিয়ে যাবে; আবার পৃথিবীপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে মেরু অঞ্চলের বরফ ও হিমবাহ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে জলে ভাসবে মানুষ। আর কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবে এবং অকালে অনাহারে, নিরাশ্রয়ী হয়ে ও দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করবে। বাড়বে মানুষের দেশান্তরী হওয়া।
বৈশ্বিক মানবিক বিপর্যয়ের কবলে পড়বে সারা পৃথিবী। এ অবনতিশীল বৈশ্বিক বিপর্যয় রুখতে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে প্রতিবছর ১৯৯০ থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নানা স্তরের মানুষকে সচেতন করতে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তা হলো-পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ছোট পরিবার গড়তে হবে। পরিবারে নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতা ও বৈষম্য বন্ধ করে সমতা সম্মান মানবাধিকারের মাধ্যমে নারী, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও উন্নয়ন বিধান করতে হবে। বাল্যবিবাহ ও অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ হ্রাস করতে হবে। করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা, জলবায়ু-প্রকৃতির অসহিষ্ণু অবস্থা মোকাবিলায় মানুষ নিরন্তর সংগ্রাম করছে।
একটি দেশের মূল অবকাঠামো হচ্ছে জনসংখ্যা। যদিও বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ দেশে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া এক ধরনের আতঙ্কের খবর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৭৪ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৩৮ লাখ এবং নারী ৮ কোটি ৩৬ লাখ। দেশের মানুষের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বেড়ে হয়েছে ৭২ দশমিক ৬ বছর। বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। এখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৩ শতাংশ। বাংলাদেশে পুরুষ ও নারীর অনুপাত ১০০.২:১০০। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে বর্তমান জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ কর্মক্ষম। আর দেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ প্রজন্ম।
দেশের ক্রমবর্ধমান নিরবিচ্ছিন্ন জনসংখ্যার জন্য কঠোর আইন তৈরি করা, সকল রাজনৈতিক দলকে বর্ণ, ধর্ম এবং সম্প্রদায় থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে এবং জাতীয় স্বার্থে একটি কঠোর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করতে হবে। জনসংখ্যা একটি দেশের জন্য আশীর্বাদ ও অভিশাপ দুটোই হতে পারে। যখনই দেশের সম্পদ দেশের জনগণের তুলনায় অপ্রতুল হয়ে যায়, তখনই দেশে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ হয় এবং এই বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরি হয়ে পড়ে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীরাও ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা রাখতে হলে প্রথমে তাদের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণ জানতে হবে । প্রথমত, সমাজে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, ছেলে সন্তানের লোভে অধিক সন্তানের জন্ম দেয়ার মতো কুসংস্কার রয়েছে, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। এছাড়াও কুসংস্কারের বিভিন্ন বেড়াজাল যে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে, তার অন্যতম কারণ অশিক্ষা বা কার্যকরী শিক্ষার অভাব। যখন দেশের মানুষের গড় আয়ু কম হয় এবং শিশু মৃত্যুর হার বেশি হয়, তখনও দেশের জনগণ অধিক সন্তানের প্রতি আগ্রহী হয়। দরিদ্র্যতার হার বেশি আর নারীর মতামতের প্রাধান্য না থাকাও জনসংখ্যা বিস্ফোরণে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।
একটি দেশে জনসংখ্যার ওপর সে দেশের শিক্ষা, অর্থনীতি, উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মান, সামাজিক অবক্ষয়সহ বিভিন্ন দিক জড়িত থাকে। উন্নত দেশে জনসংখ্যা কম হওয়ায় মাথাপিছু আয়ও বেশি। সরকারের নারী শিক্ষা উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া বাল্যবিয়ে রোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ আরো নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি জনগণকে সচেতন করতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বাল্যবিবাহের কুফল জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। কেননা বাল্যবিয়ে রোধ করতে পারলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অনেকটা সহজ হবে। তবে জনসংখ্যা কখনই সমস্যা নয়, এটি হলো সম্পদ। কেননা জনসংখ্যাই হতে পারে জনসম্পদ। তাই জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে । এজন্য সরকারের সঙ্গে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক