আত্মনির্ভরশীল সমাজ গঠনে নারীদের ভুমিকা - দৈনিকশিক্ষা

আত্মনির্ভরশীল সমাজ গঠনে নারীদের ভুমিকা

বিপ্লব বড়ুয়া |

উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত হচ্ছে প্রত্যেক নাগরিককে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলা। সমতা ছাড়া কখনো আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠন সম্ভব নয়। আজকে তৈরি পোশাক শিল্প খাত এতো উন্নত হওয়ার পেছনে নারীদের অবদান সর্বাগ্রে। নারী হচ্ছেন দেশের একটি দক্ষ জনশক্তি। দেশের একটি বৃহৎ জনসংখ্যাকে বাইরে রেখে কখনো কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করতে পারে না। আমাদের মতো পশ্চাদপদ, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার হাতেগোনা কয়েকটি দেশ কর্মক্ষেত্র নারীদের জন্য উপযুক্ত স্থান তৈরি করতে পেরেছে। তাই এই ব্যাপারে সরকারকে আরো বেশি কৌশলী ও মনযোগী হতে হবে। 

নারী বলুন আর পুরুষ বলুন, লিঙ্গের কারণে আলাদা আলাদা মানুষ হলেও এখানেই পরিচয় শেষ নয়। একজন পুরুষের যেমন পারিবারিক দেয়া নাম থাকে সেভাবে নারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নামেতে কিছু যায় আসে না। নাম হচ্ছে শুধুমাত্র একটি পরিচয় হওয়ার যোগসূত্র। এই নামের পরেও প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রে অগোচরে আলাদা আরেকটি পরিচয় গড়ে ওঠে। সে পরিচয়টা হয় একমাত্র কর্মের দ্বারা। সেটা হোক একজন কৃষক তাতে কিছু যায় আসে না। এই পরিচয়টা একজন কৃষকের আত্মমর্যাদা ও সম্মানের। এ ছাড়া ব্যবসায়ী, কামার, কুমার, জেলে, মুচি, তাঁতী, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ইত্যাদি পেশার মানুষের আলাদা কদর ও বৈশিষ্ট্য আছে বলেই গুরুত্বও কোনো অংশে কারো কম নয়। 

পৃথিবীতে কোনো কর্মই ফেলনার নয়। পেশাকে কোনো সময় ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। ভাবতে অবাক লাগবে করোনাকালীন দীর্ঘ লকডাউনের সময়ে কতো হাজার হাজার লোক চাকুরিচ্যুত হয়েছে, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। কারো কারো তো জন্ম বেড়ে ওঠা ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো মেগা শহরে, অভাব অনটনের কারণে শূন্য হাতে অনেককে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যেতে হয়েছে। আবার পেশা পরিবর্তন করে নতুন করে জীবন ধারণ করেছে। আবার কেউ কেউ এমনভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রীতিমতো সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। 

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার লক্ষ্মীদ্বার গ্রামের দয়াল চন্দ্র বর্মনের কথাই যদি বলি- তিনিতো খুব দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান করোনার লকডাউনের সময় ঘরবন্দী হলে তিনি এই সময়টাকে ইংরেজিতে কথা বলাকে কাজে লাগিয়ে দেশব্যাপী একটি বিশাল পরিচিতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কখনো নামী স্কুল কলেজে পড়েননি। এমনকি কলেজে উঠেই পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। পরিবারের সঙ্গে কৃষিকাজ করলেও ইংরেজির প্রতি তার ভীষণ আগ্রহ ছিলো। ফসলি জমিতে কাজ করতে করতেই তিনি অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতেন। আর ইংরেজির ওপর একটি কনটেন্ট বানিয়ে দেশজুড়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন দয়াল। তাকে এখন অনুসরণ করার সংখ্য ফেসবুক ও ইউটিউব মিলে তিন লক্ষাধিক। এ রকম আরো বহু উদাহরণ আছে। আরেকটি উদাহরণ আমি দিতে পারি, আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ, যার সঙ্গে আমার দীর্ঘ তিন দশকের কাছাকাছি সময় সৃজনশীল শিল্প প্রকাশনায় যুক্ত থাকতে হয়েছে। যিনি দেশে-বিদেশে ইতিমধ্যে অসাধারণ সৃজনশীল মানুষ হিসেবে নিজের পরিচিতিকে অসামান্য করে তুলেছেন। চারুআড্ডার পরিচালক চারুউত্তম বড়ুয়া’র কথায় আপনারা ধরুন। করোনার সময় তিনি যেটি করেছেন, মানুষ যখন নিজেকে নিয়ে দ্বন্দ্ব-সন্দিহান, অসহায়ত্বের মধ্যে ডুবে ছিলো, মৃত্যুর প্রহর গুণছে তিনি সেই সময়ে একমাত্র মানুষদের উজ্জীবিত করতে, উৎসাহ-অনুপ্রেরণা যোগাতে এই চারুআড্ডাকে লাখ লাখ মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে সক্ষম হন। ধর্ম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য এমনকোনো বিষয় ছিলো না যা তিনি উপস্থাপন করেননি। সময়ে সময়ে তিনি দেশ-সমাজ-সম্প্রদায়ের খুঁটিনাটি বিষয় মানুষের সামনে তুলে এনেছেন এবং উজ্জীবিত করেছেন। সে কারণেই আজ তার পরিচিতিটা কী পরিমাণ প্রসারিত হয়েছে চিন্তা করা যায়। 

এ জন্য বলি মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়াই কোনো সার্থকতা নয়। সার্থকতা হচ্ছে তার কর্মে। আমার পরিচিত অনেককে বলি একজন মেথর নালার মলমূত্র বা সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করে মাত্র আধ ঘণ্টার শ্রমের বিনিময়ে তিনি তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় করেন। এই আয় বাংলাদেশের অন্য যেকোনো পেশার মানুষের বেলায় হবে কি? না, হবে না। বেশি আয় করছে বলেই কি তারা অনেক সুখি? সুখ কি অর্থ দিয়ে কেনা যায়? যে দ্বীন-দরিদ্র মানুষ সেকি সুখি নয়? সুখ আর দুঃখ হচ্ছে একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। এটি কোনোভাবে অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। তেমনি কোনো পেশাকে ছোট বা বড় করে দেখার সুযোগ নেই। 

আজ বাংলাদেশের নারীরা সকল ক্ষেত্রে এগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী-পুরুষ সবাইকে সমানভাবে মূল্যায়ন করছেন। তিনি সেদিন এক বক্তৃতায় আক্ষেপ করে বললেন, তার খুব ইচ্ছা একজন নারীকে বিচারপতি হিসেবে দেখার। ভবিষ্যতে আশাকরি সে আকাঙ্ক্ষাও তিনি পূরণ করবেন। তবে আমরা কথায় কথায় ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলে তার বরখেলাপ করি। সেটা যাতে না হয়। যেমন-গণতন্ত্রের কথা বলে কাজ করি অগণতান্ত্রিক! আজকাল মেয়ে বলুন আর ছেলে বলুন তাদের মধ্যে শিষ্টাচার, নমনীয়তা, ভদ্রতা উবে গেছে। রাস্তাঘাটে বের হলে মনে হয়ে এটি আর বাংলাদেশ নেই। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে ভরে গেছে। শহর থেকে গ্রামে মাদকে ছেয়ে গেছে। কাপড়-চোপড় থেকে শুরু করে আচার-আচরণে সুশিক্ষার কোনো বালাই নেই। পার্ক-বিনোদন কেন্দ্রগুলোতেও এখন স্বস্তি নেই। উঠতি তরুণ-তরুণীদের অনৈতিক মেলামেশা সমাজকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই যদি আমাদের সন্তানদের অবস্থা হয় তাহলে স্বাধীনতার অর্থ কী দাঁড়ায় আপনারাই বলুন। 

একবিংশ শতাব্দীর এ পর্যায়ে এসে আজকে আমরা অনেক নারীকে উদাহরণ হিসেবে উদ্ধৃত করতে পারি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী হয়েও যারা ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরের উজ্জ্বল হয়ে আছেন অনেকেই। এদের মধ্যে সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী, সমাজসংস্কারক, নারী অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রসেনানী স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, চারুবালা বড়ুয়া অন্যতম। সাহিত্যিক শিক্ষাবিদ শহীদ জননী জাহানা ইমাম, কবি বেগম সুফিয়া কামাল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাজনীতিক সাজেদা চৌধুরী, রাজনীতিক অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী, একুশে প্রদকে ভূষিত, ভাষাসংগ্রামী শিক্ষাবিদ প্রতিভা মুৎসুদ্দী, রবীন্দ্র গবেষক সানজিদা খাতুন, শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ প্রীতিকনা বড়ুয়া, শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. সুনন্দা বড়ুয়া।  এ ছাড়া ১৯৭১ ক্রিষ্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানী, আত্মদানের সেই কালজয়ী ইতিহাসের কথা কেউ কোনোদিন ভুলবে না। তারা নারী জাগরণের অগ্রদূত, পথপ্রদর্শক। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী সমগ্র বিশ্বে নারীদের মধ্যে একজন অসম্ভব প্রতিভাশালী ও ক্ষমতাধর নারী হিসেবে নারীদের মর্যাদা ও সম্মানকে অনেক বেশি এগিয়ে নিয়েছেন। 

নারীবাদের জনপ্রিয় লেখক মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট-এর জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরে লেখার ইতি টানতে চাই। মেরির (জন্ম ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে, মৃত্যু ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে) জন্ম লন্ডনের বাইরে এপিং বনের কাছাকাছি এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। আগাগোড়া জীবনটাই ছিলো তার সংগ্রামের। অভাব অনটনের কারণে ছোটকালেই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে মেরিকে। কতোকিছুই যে করতে হয়েছে তার কোনো সঠিক হিসেবে নেই। প্রথম দিকে যে কাজই করেছে সবগুলোতে ব্যর্থ হয়েছে। তার জীবনের প্রথম কাজটি ছিলো এক বিত্তশালী বিধবাকে সেবাযত্ন করা। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। তার বাবা ছিলেন রাগী, অত্যাচারী; মা ছিলেস ভীরু। মেরি বেড়ে ওঠেন খামারে খামারে। লেখাপড়া করার যৎসামান্য সুযোগ-সুবিধাও তার কপালে জোটেনি। তবে স্বাধীনচেতা ছিলেন। ৩২ বছর বয়সে মাত্র ৬ সপ্তাহে লেখেন তার তেরো পরিচ্ছদের অসম্ভব জনপ্রিয় ভয়ংকর বইটি। যেটি হাতে লিখে পুরো এক বছরেও কেউ শেষ করতে পারবে না। তার বইয়ের নাম ছিলো “ভিন্ডিকেশন অব দ্য লাইটস অব ওম্যান’। এই বইটিই ছিলো নারীবাদের প্রথম মহা-ঘোষণা। বইটি প্রকাশিত হয় ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে। এটি ছিলো মানুষের লেখা সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক, বিখ্যাত ও আপত্তিকর বইগুলোর মধ্যে একটি। বইটি প্রকাশের পর ইতিহাসের প্রথম বিপ্লবী নারী লেখক হিসেবে মেরি পান প্রগতীশীলদের অভিনন্দন ও প্রশংসা। তবে তার কপালে নিন্দাই জোটে বেশি। তার এই বই প্রকাশিত হলে পুরষতন্ত্র ক্ষেপে ওঠে, রক্ষণশীলদের কাছে মেরি হয়ে ওঠেন এক নিষিদ্ধ ঘৃণ্য নাম। তার আগে কোনো নারী লেখাকে উপজীব্য করে জীবিকার পথে হাত বাড়াননি। অভিনব পেশা গ্রহণের পর মেরির জীবন হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ কর্মের ও লক্ষ্যের; যেমন মেধাবী ছিলেন তেমনি ছিলেন রোম্যান্টিক। নারীবাদের আদর্শ জননী হিসেবে তিনি আজো অজেয়, জীবন্ত কিংবদন্তি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে নারী হয়ে উঠুক আত্মপ্রত্যয়ী আত্মমর্যাদার প্রতীক। 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

 

ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037519931793213